**

৭. আলোকচিত্রী জাহরা জাহান পার্লিয়া’র ভিডিও রিভিউ

**

৬. কথাসাহিত্যিক হাসান মাহবুব এর আলোচনা

“আশান উজ জামানের অন্যচোখে উপন্যাসটি পড়ার আগে এটির মুখবন্ধ এবং অন্যান্য সহায়ক লেখা পড়ে কিছুটা শঙ্কিত হয়েছিলাম। এই উপন্যাসে নাকি যুদ্ধের অন্যপিঠও দেখানো হয়েছে। রাজাকার, পাকসেনা এদের জীবন এবং পরিবারের কথাও এসেছে। আমার মনে পড়ে গেলো মেহেরজান চলচ্চিত্রের কথা। ভিন্নচোখে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকসেনাদের দেখাতে গিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার তৈরি করেছিলেন পরিচালক। শেষপর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হল থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য করে সিনেমাটি। সাহিত্য এবং চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ভিন্নচিন্তা এবং ভিন্নদৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণকে আমি সসবসময় স্বাগত জানাই, এবং আগ্রহ নিয়ে স্বাদ নেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে অতটা উদার হওয়া কি সম্ভব, বা উচিত? অন্যচোখে মুক্তিযুদ্ধকে দেখার এই প্রয়াস ছিলো ভীষণ উচ্চাভিলাষী এবং সাহসী। স্পর্শকাতর এই ব্যাপারটি আশান উজ জামান কীভাবে সামলাবেন তা দেখতে কৌতূহল হচ্ছিলো বেশ! উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়েই এর উত্তর পেয়ে যাই। এখানে উল্লেখ্য, উপন্যাসের প্রতিটি অধ্যায় আপনি চাইলে আলাদাভাবে গল্প হিসেবেও পড়তে পারেন। এগুলোর প্রতিটি যদি স্বতন্ত্র গল্প হয়, তাহলে একে গল্পগ্রন্থ না বলে উপন্যাস বলা হচ্ছে কেন! আসছি সে কথায়।
প্রথম গল্পটি নিয়ে বিশেষ আলোচনা প্রয়োজন। কারণ এই গল্পটির মাধ্যমেই উপন্যাসের বলার ধরণ এবং বক্তব্য নিয়ে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। আমরা দেখতে পাই একজন পাকসেনাকে, রণাঙ্গনে। তার সামনে একটা লাশ। সে উদভ্রান্ত। তার মার কথা মনে পড়ছে, ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে, জমিজমার ঝামেলার কথা মনে পড়ছে…পাক হানাদার বাহিনীর মনের এই দিকটা উন্মোচনের প্রচেষ্টা এর আগে কেউ করেছে বলে জানি না। প্রথমদিকে আমি বুঝতে পারি নি সৈনিকটি বাঙালী না কি পাকিস্তানী। এই যে পরিবারের পিছুটান, প্রেমাস্পদকে রেখে আসার বেদনা, বৈষয়িক ভাবনা, এ তো সারা পৃথিবীতে খুব ভিন্ন কিছু না মানুষভেদে। কিন্তু যুদ্ধের সময় এই পাকসেনারা এত ভয়াবহ পাশবিক উন্মত্ততায় মেতে উঠলো কীভাবে? অতি অল্প সময়ে এত হত্যা এবং ধর্ষণ তারা কিসের তাড়নায় করেছে? আশান উজ জামান এবার মনোযোগ দিলেন এই দিকটা উন্মোচনে। আমরা দেখতে পেলাম পরিবার-পরিজন ছেড়ে আসা এই সৈনিকেরা কীভাবে মানুষ থেকে সাচ্চা পাকিস্তানী হয়ে উঠলো, কী পরিমাণ ঘৃণা, আর বিদ্বেষ পুষে রেখেছিলো তারা বাংলাদেশীদের জন্যে! আমরা দেখতে পেলাম তারা কীভাবে মন্ত্রপুত দানব হয়ে ওঠে। তারা আমাদের মানুষ হিসেবে গণ্য করতো না। আমরা তাদের চোখে ছিলাম গাদ্দার, শায়তান, কাফির! আমাদের হত্যা করলে পুণ্য মিলবে, এই বলে তাদের উদ্দীপ্ত করতো অফিসারেরা। আমরা দেখতে পাই যুদ্ধের সময় বিন্দুমাত্র দুর্বলতা এলেও এই মন্ত্রের জোরে তাদের সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে ওঠা। দেখতে পাই সাক্ষাৎ পিশাচকে! ইতিহাস যত নিরপেক্ষ এবং নৈর্ব্যক্তিকভাবেই দেখা হোক না কেন, পাকিস্তানী সেনাদের পরিবার পরিজন টেনে এনে যতই চিনিলেপন করা হোক না কেন, যুদ্ধের ঐ সময়টায় আশ্চর্য নিষ্ঠুরতায় তারা সেসব মানবিক খেতাব ছুড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো। রণাঙ্গনে এই মানসিক পালাবদলের সুক্ষ্ণ বাঁকগুলি সূচারুভাবে ফুটে উঠেছে প্রথম অধ্যায় বা গল্পটিতে। আশান উজ জামান পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে যুদ্ধ দেখানোর সময় স্পষ্ট দুটি বিভাজনে ভাগ করেছেন সেখানকার মানুষকে। একপাশে নিষ্ঠুর সৈনিক অথবা বিভ্রান্ত পুরুষ, অন্যপাশে নারী। নারী চরিত্রগুলির প্রতি তিনি ছিলেন সদয় এবং সহানুভূতিশীল। মায়ের জাত আর যাই হোক ধর্ষণ নিশ্চয়ই মেনে নেবে না, সে পৃথিবীর যে প্রান্তের, যে গোত্রেরই হোক না কেন! হ্যাঁ, চৌদ্দহাজার মানুষকে হত্যা করা উন্মাদ সৈনিকের মা’ও পৃথিবীর অন্যান্য মায়ের মতই, মমতা ধারণ করেন, এই বার্তা আসলে পৃথিবীর সব যুদ্ধ এবং বেশিরভাগ অপরাধের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আশান উজ জামানের এই দৃষ্টিভঙ্গি আমি সমর্থন করি।
এরপরের প্রতিটি অধ্যায়ে আলাদা গল্প বলা হয়েছে, তবে সেখানে অন্যদৃষ্টি সবসময় তেমনভাবে উপস্থিত নয়। এগুলো একান্তই আমাদের গল্প। কখনও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বন্ধুর জন্মদিন পালন করতে গিয়ে নরক নেমে আসে, কখনও মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবন তছনছ করে কেড়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের মেয়েকে, কখনও দুগ্ধভরন্ত স্তনের যন্ত্রণা নিয়ে ছেলেকে ফেলে যাওয়া মা, কখনও পড়ন্ত জমিদারী বজায় রাখতে চাওয়া হিন্দু পরিবারের শারীরিক ত্রুটি নিয়ে বেড়ে ওঠা ছেলেটার বিপর্যয় এবং বীরত্ব, এমন অনেক গল্প। এর মধ্যে লেখক অন্যচোখে দেখেন পাকিস্তানী কর্মকর্তার সঙ্গ ছাড়তে বিফল হওয়া একজন বাঙালী হাবিলদারের করুণ পরিণতি, আবার একজন রাজাকারের পাকি মারতে উন্মুখ হয়ে ওঠা, যে তার প্রেয়সীকে হানাদারদের কাছে হারিয়েছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, প্রতিটি গল্পই তো আলাদা, তাহলে এটি উপন্যাস হলো কীভাবে? এখানেই লেখক তার সূক্ষ্ণ কৌশল প্রয়োগ করেছেন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, গল্পগুলো আসলে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না একে অপরের থেকে। রুশি নামের যে মেয়েটিকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, তাকে অন্য এক গল্পে এক টর্চার চেম্বারে এক মুক্তিযোদ্ধার পাশে দেখা যায়। তারা একে অপরকে সাহস যোগায়। এদিকে প্রথম গল্পের হানাদার শামসের ভাই হেলাল অন্য অধ্যায়ে হয়ে ওঠে প্রধান চরিত্র। সে তার মাকে নিয়ে মানসিকভাবে অপ্রকৃতস্থ ভাইকে দেখতে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্মদিন উদযাপন করতে গিয়ে বিভৎস হামলার সম্মুখীন হওয়া নাড়ুকে আমরা অন্য গল্পে দেখতে পাই অস্ত্র হাতে।
কিছু গল্প শুধুমাত্র আলাদাভাবে গল্প হিসেবেই অনন্য, আর কিছু গল্প উপন্যাসের সংযোগসূত্র হিসেবেই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। আমাকে সবচেয়ে নাড়া দিয়েছে ‘মুক্তি’ গল্পটি। এখানে রণাঙ্গন নেই, ভয়ংকর অত্যাচারের বর্ণনা নেই, আছে এক অসহনীয় গুমোট মানসিক অবস্থার বর্ণনা। একটি পরিবারের অতি আদরের মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করলে আবার ফিরিয়েও দেয়া হয়। একটু সুস্থ হবার পর নিয়মটা এমন দাঁড়ায়, প্রতিদিন তাকে নিয়ে যাবে, আবার দিয়ে আসবে। উফ, আর বলতে পারছি না! আমার পড়া সবচেয়ে গুমোট এবং অস্বস্তিকর গল্পের মধ্যে এটি একটি। এই মেয়েটিকে, রুশিকেই আমরা অন্য এক গল্পে দেখি প্রবল টর্চারেও ভেঙে না পড়া মুক্তিযোদ্ধা মিনুকে সাহস দিতে। আবার পাকিস্তানে একজন বিরলপ্রাণ মানবিক পাকিস্তানীর সাথে সাচ্চা মুসলিম হতে চাওয়া অমানবিক অন্যদের তর্কেও রুশি চলে আসে।
বিশেষ করে আরেকটি অধ্যায়ের কথা না বললেই নয়, ‘যুদ্ধ’। সাপের বিষে আক্রান্ত রাজাকারের বিষ ছোটাতে আসা ওঝার মানসিক টানাপোড়েনটা উপভোগ করেছি।
গল্প হিসেবে প্রায় প্রতিটিই সফল, এবং যত্নের সাথে তৈরি করা। প্রচুর চরিত্র, প্রচুর নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করতে লেখক অনেক সময় এবং শ্রম দিয়েছেন। তবে যেহেতু এটি একটি উপন্যাস, তাই গল্পগুলির মধ্যে সংযোগসূত্র আরো জোরালো হওয়া দরকার ছিলো। পাঠক একটু আনমনা হলে গল্পগুলির আন্তসম্পর্ক ধরতে ব্যর্থ হতে পারেন। গল্পগুলির সূতোর টান অনেকক্ষেত্রেই বেশ সূক্ষ্ণ, আর তার ওপর কোনো একটি বিষয় বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক বেশি আনুষঙ্গিক ব্যাপার চলে আসায় পাঠক দিশেহারা বোধ করতে পারেন।
কিছু কিছু জায়গায় জাদুবাস্তবতা এবং কল্পনার চমৎকার মন্টাজ তৈরি হয়েছিলো, যেমন প্রথম অধ্যায়ে ঘাতক পাকিস্তানী শামসের মায়ের উপস্থিতি, অথবা ‘বৈঠা’ অধ্যায়ে শহিদকে ইয়াহিয়া খানের দাওয়াতের প্রেক্ষাপট। লেখক চাইলেই এ ধরণের উপাদান আরো বেশি ব্যবহার করে অধ্যায়গুলোর সংযোগসূত্র আরো পোক্ত করতে পারতেন, অথবা অন্য কোন কৌশল ব্যবহার করতে পারতেন, যাতে স্বতন্ত্র গল্পপাঠের চেয়ে উপন্যাস পাঠের অনুভূতিটা আরো জোরদার হতো।

লেখকের অন্যচোখে দেখা অব্যাহত থাকুক, পড়তে চাই আরো অন্যরকম লেখা।”

নভেম্বর ২৩, ২০১৮

**

৫. কবি ও গল্পকার সানোয়ার রাসেল এর আলোচনা

“অন্যচোখে মুক্তিযুদ্ধ; বাংলা উপন্যাসে আশার আলোকবর্তিকা

মুক্তিযুদ্ধ। ঊনিশশো একাত্তর। একটি ঘটনা। একটি সময়খণ্ড। যুদ্ধকাল। এই বঙ্গ ভূখণ্ডে ঘটে যাওয়া এযাবতকালের সবচেয়ে প্রভাবশালী ঘটনা ও সময়। বলা চলে ঊনিশশো একাত্তরের আগের বাংলা ও পরের বাংলা কখনই এক নয়, না চেহারায়, না চেতনায়। এরকম একটি যুদ্ধকালকে মাত্র সাতচল্লিশ বছর পরেই ভিন্নচোখে দর্শন করা প্রায় অসম্ভব। প্রায় না বলে একেবারে অসম্ভব বলাই ভালো। এত বৃহৎ ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি সময়খণ্ডকে আবেগবিবর্জিতভাবে কেবলই নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাসের বিচারে পর্যালোচনা করা আরও শতবর্ষ পরেও ঐতিহাসিকদের পক্ষেই কঠিন হবে বলে ধারণা করা যায়। আর সেক্ষেত্রে একজন ঔপন্যাসিক কিভাবে গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ভিন্নদৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে স্বাধীনতার মাত্র সাতচল্লিশ বছরের মাথাতেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস রচনা করতে পারেন! তাও আবার যার জন্ম সত্তরের দশকেরও পর! মূলত এরকম একটা কৌতূহল মাথায় রেখেই হাতে নিয়েছিলাম আশান উজ জামানের ‘অন্যচোখে’ উপন্যাসটি।

‘অন্যচোখে’ উপন্যাসটি শুরু হয়েছে পাকিস্তানি এক সৈনিক শামসের হাত ধরে। শামস, যে পঁচিশে মার্চের কালরাতে কুখ্যাত অপারেশন জ্যাকপটের একজন পাকি সেনাসদস্য। মনের মাঝে মালাউন শত্রুদের খতম করার উদগ্র বাসনা নিয়ে যে পূর্ববঙ্গে আসে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে নির্বিচারে ছাত্রহত্যার দৃশ্য দেখে সে নিজেই হতবিহ্বল হয়ে যায়। নিজের হাতে হত্যা করা ছাত্রকে মনে হতে থাকে নিজেরই সহোদর ভাই হেলাল! লাশের সাড়ির মাঝে নিজেরই লাশ দেখতে পায় শামস। লাশের পাশে নিজের মা’কেও বিলাপ করতে দেখে। আরও দেখে তার প্রিয়তমা ফাতিমাকে। ফাতিমা যেন তার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে! কেন হাসছে সে? তার উত্তর শামস খুঁজে পায় না। এভাবেই একজন পাকিস্তানি সৈনিক শামসের ভিতরে বসবাস করা একটা মানুষের ভেঙ্গে পড়ার গল্প দিয়ে উপন্যাসটি শুরু হয়। আমিও আশ্বস্ত হই, শুরু দেখে মনে হতে থাকে উপন্যাসটির ‘অন্যচোখে’ নামকরণ হয়তো বৃথা যাবে না।

আশান সুনিপুণ গল্পকার। মালা গাঁথার একটা প্রবণতা তার লেখার মাঝে খুঁজে পাই। আশান বারোটি পৃথক পৃথক শিরোনামের পরিচ্ছদে সমগ্র উপন্যাসটি সাজিয়েছেন। এক একটি পরিচ্ছেদ যেন এক একটি ছোটগল্প। ‘সংক্রান্তি’ শিরোনামে শুরু হয়ে তা শেষ হয়েছে ‘পতাকা’ শিরোনামের গল্প দিয়ে। বিষয়টি বেশ অভিনব। পুরো উপন্যাসটি না পড়ে কোন পাঠক যদি হুট করে মাঝখান থেকেও কোন পরিচ্ছেদ পাঠ করা শুরু করেন, তবু তিনি একটি ছোটগল্প পাঠের আনন্দ পাবেন। এভাবেই বারোটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ভিন্ন ভিন্ন গল্পকে এক সূত্রে গেঁথে আশান রচনা করেছেন গোটা উপন্যাসটি। কী বলবো একে? মালা? নাকি মোজাইক? যাই বলি না কেন, তাতে উপন্যাসের স্বাদ এতটুকুও হ্রাস পায় না।

আশানের গল্প বলার ভঙ্গিটিও একজন মালাকারের মতই। ছোট ছোট, অথচ পরম্পরাযুক্ত বাক্য তার গদ্যের বৈশিষ্ট্য। নাতিদীর্ঘ বাক্যের মালা গেঁথে একটা বৃহৎ দৃশ্যের বয়ান। সহজ ভাষা, উপভোগ্য। ক্রিয়ার কালের মিশ্র ব্যবহার। সব মিলিয়ে পাঠককে ক্লান্ত না করেই গন্তব্যে পৌঁছে দেয়।

এই উপন্যাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এতে বহু বিচিত্র চরিত্রের সমাহার রয়েছে। পাকিস্তান আর্মির সেনা শামস, তার ভাই হেলাল, মা, প্রেমিকা ফাতিমা, বাঙ্গালি কবি আসাদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদ, নারায়ন ওরফে নাড়ু, মুক্তিযোদ্ধা মিনু, ছোট্ট শিশু শায়রা, তার মুক্তিযোদ্ধা চাচা শান, পাকিস্তানি মেজর শওকত, দরিদ্র নারী শহরবানু, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বুদু, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কর্তব্যপরায়ন বাঙ্গালি হাবিলদার কাশেম, বস্তিবাসী নারী বেগম ও তার শিশু সন্তান গুলতু, গুলি খাওয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালি ক্যাপ্টেন ওবায়েদ, শরণার্থী গর্ভবতী রমণী রুইতন, বীরাঙ্গনা যুবতী রুশি, রুশির অসহায় পিতা, লেংড়া মাঝি আরব আলী, বোকাসোকা কিন্তু ভীষণ আবেগী ভীম, রাজাকার আব্বাস আলী ও আজম আলী, সাপের বিষ নামানোতে দক্ষ ছেদু, বাংলাদেশের প্রতি সংবেদনশীল পাকিস্তানী যুবক কাবিল, রাজাকার রাজাক আলী ও ইয়াকুব আলী সহ আরও অনেকগুলো চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে এই উপন্যাসে। কিছু কিছু চরিত্র কেবল একটি পরিচ্ছেদেই এসেছে, আর কিছু চরিত্র ঘুরে ফিরে হাজির হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গল্পে। তবে মজার বিষয় হলো, এই উপন্যাসে কোন মানুষকেই মূল চরিত্র হিসাবে আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। গোটা উপন্যাসজুড়ে মূল চরিত্র হিসাবে যা পেয়েছি তা হলো মুক্তিযুদ্ধ, ঊনিশ শো একাত্তর, যুদ্ধকাল। এক অবিস্যম্ভাবী, অনিবার্য ও অপরতিরোধ্য অস্তিত্ব এই যুদ্ধকালই উপন্যাসটির মূল চরিত্র।

এখানে পাওয়া যায় একাত্তর নিয়ে পাকিস্তানি সৈনিকের মনোভাব। পাশবিক আনন্দ নিয়ে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠা সৈনিকের মনেও প্রশ্ন জাগে নিরস্ত্র, নিষ্পাপ মানুষদের মারা ওর কাজ কি না? নিজের সাথে সমঝোতায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সে মেতে ওঠে হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসলীলায়। এখানে দেখতে পাই, যেই মন হত্যা করে খুশি হয় সেই মন আবার একই সাথে কেঁদেও ওঠে! কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের হত্যাযজ্ঞ দেখে হতভম্ব শহীদ তার পূর্ব অভিজ্ঞতার সাথে মানুষের নিষ্ঠুরতার মাত্রা মিলিয়ে দেখতে চায়। কিন্তু একাত্তরে হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কাছে তার অভিজ্ঞতা হার মানে। শিশুর চোখে যুদ্ধকাল কেমন? শায়রার অভিজ্ঞতায় আমরা তা জানতে পারি। শায়রা ভাবে আর্মিরা তার ছোট চাচ্চুকে ধরতে পেলে হয় অঙ্ক করতে দিতো, কিংবা মশার টাঙ্গাতে দিতো, কিংবা টয়লেট পরিষ্কার করাতো। অথচ সেই অবুঝ শিশুটিও মৃত্যুর পূর্বে বুলেটের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদায় নেয়। আমরা দেখতে পাই মা বেগম তার সন্তানের জীবন বাঁচাতে রাজাকারের কাছে নিজের নারীত্বকে বিলিয়ে দেয়। তবু সন্তান থেকে বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা সইতে হয় তাকে। এভাবে বীরাঙ্গনার ত্যাগ, তার পিতার লজ্জা, মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব, সাধারণ মানুষের সহযোগ, যুদ্ধকালীন পরস্পর অবিশ্বাস, শরণার্থীদের দুঃসহ কষ্ট, রাজাকারদের অত্যাচার, নিজেদের ভিতরকার রেশারেশি, পাকিস্তানি মেজরের নিষ্ঠুরতা, আবার নিজের সন্তানের জন্য দুশ্চিন্তা, বিজয়ের পর রাজাকারদের মুক্তিযোদ্ধা সেজে যাওয়া এই সব গল্প আমাদের একাত্তরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সেই সাথে আশান এ কথা মনে করিয়ে দিতেও ভোলেন না যে যুদ্ধ কখনও শেষ হয় না। উপন্যাসটি তাই শেষ হয় এইভাবে, ‘দ্রুত পা চালালো ওরা। নাড়ু আর মতিন। যুদ্ধ শেষ হয়নি। হয় না।’

আশান যুদ্ধকালের গল্প বয়ান করতে গিয়ে সাহিত্যকে ত্যাগ করেন না। অপূর্ব কিছু বিবৃতি উপন্যাসের সাহিত্যমূল্যের প্রমাণ রাখে। যেমন, ‘মৃত্যু তো ঘুমেরই মতো। ঘুম তো মৃত্যুরই মহড়া। সময় হলে আসে। সারাবেলা জ্বালিয়ে রাখা স্বার্থের আলো নিভিয়ে মানুষ শুয়ে পড়ে, আশা রাখে পরে আবার উঠবে, কিন্তু ওঠে না।’ কী সুন্দর! কী কাব্যিক! আবার স্থানীয় উচ্চারণে ও পাকিস্তানী ভাষায় চরিত্রের সংলাপ নির্মানেও আশানের দক্ষতার ছাপ দেখতে পাই।

উপন্যাসে আরও উঠে আসতে পারতো বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারীদের চোখে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান, কিংবা দেশে অবস্থিত বিদেশী সাংবাদিক ও কূটনৈতিকদের দৃষ্টিতে তৎকালের অবস্থা, অনিচ্ছাকৃতভাবে শান্তিবাহিনীর সদস্য হওয়া মানুষদের মানসিক দ্বন্দ্ব, মুক্তিযুদ্ধে নিহত পরাজিত পাকিস্তানী সেনার পরিবারের মুখের বয়ান ইত্যাদি। তাহলে উপন্যাসটির নাম ‘অন্যচোখে’ রাখা আরও স্বার্থক হতো বলে আমার মনে হয়।

প্রথম উপন্যাস। তাও আবার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। যেমন প্রয়োজন সাহস, তেমনি প্রয়োজন ইতিহাসের প্রতি সততা, সেই সাথে দেশপ্রেম। আশানের গদ্যের মুন্সিয়ানার সাথে আগেই পরিচয় হয়েছিলো। এবার এই তিনটেরও পরিচয় পেলাম তার ‘অন্যচোখে’ উপন্যাসে। উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের পাঠক ও সমালোচকমহলের মনোযোগের দাবী রাখে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলা সাহিত্যজগত আরও একজন শক্তিশালী ঔপন্যাসিক পেতে যাচ্ছে, আশানকে নিয়ে এমনটা আশা করতেই ভালো লাগছে।”

সাহিত্য পত্রিকা জলধি’র জুলাই ২০১৮ বই আলোচনা সংখ্যায় প্রকাশিত।

**

৪. গল্পকার শারমিন রহমান এর আলোচনা

“একটা ঘুমন্ত জাতির উপরে অতর্কিত হামলা- ঘরে ঘরে আগুনের লেলিহান শিখা। পুড়ে মরছে কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই, কেউ কেউ বুলেট বুকে নিয়ে তাজা রক্তে ভিজিয়ে দিচ্ছে দেশের মাটি। লাশপোড়া, স্বপ্নপোড়া ধোঁয়ায় ভরে উঠেছিল দেশ! সেই স্বপ্ন পোড়া ছাই গায়ে মেখে যাঁরা লাল সবুজের পতাকা ছিনিয়ে এনেছিল, তাঁদের ত্যাগ আর বীরত্বগাথা রক্তাক্ত মুক্তোদানার মতো ছড়িয়ে আছে অন্যচোখে উপন্যাসের পরতে পরতে।
বারোটি ছোটগল্পের সমন্বয়ে একটি উপন্যাস। প্রতিটি গল্পই স্বতন্ত্র কিন্তু যোগসূত্র রয়েছে একটার সাথে অন্যটার। আশান উজ জামান তার ‘অন্যচোখে’ উপন্যাসে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বেশ কিছু অনালোচিত বিষয় তুলে ধরেছেন নিঁখুতভাবে। বাদ পড়েনি পাকিস্তানিদের অত্যাচারে মারা যাওয়া মায়ের পেটের ভেতর মরে যাওয়া ভূমিষ্ঠ না হওয়া শিশু, মুক্তিযুদ্ধে অতি সাধারণ নারী ও পুরুষের অনাড়ম্বর কিন্তু বীরোচিত অংশগ্রহণ, রাজাকার আলবদরদের বহুরূপী ভূমিকা কিংবা প্রবাসী বাঙালীদের অবদানের কথাও।
বইটি লেখক উৎসর্গ করেছেন ” সেইসব বাঙালিকে, ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই যারা যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। জীবন দিয়েছেন। মিশে গেছেন প্রিয় পতাকার সূর্যে।” এমন করে কি ভেবেছি কোনোদিন আগে?
এ উপন্যাসের প্রথম গল্পের নাম সংক্রান্তি। গল্পের শুরুটা হয়েছে লাশের স্তুপ থেকে। ” লাশটা পড়ে আছে সামনেই। হাত তিনেক দূরত্বে। ঠিকরে বেরুনো চোখে তাই দেখছে শামস।”
শামস এখানে একজন পাকিস্তানি সৈনিক। যাকে বিয়ের দুদিন আগেই দায়িত্ব পালন করতে নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকায়। বোঝানো হয়েছে, বাঙালীরা গাদ্দার, দেশদ্রোহী, ভারতের চর। মুসলমানদের ভাগ করতে চায় এরা। এসব ‘গাদ্দারদের’ খতম করে দেশপ্রেমের ইতিহাস গড়তে উন্মত্ত শামসরা হামলে পড়েছে জগন্নাথ হলে। শুরু হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। সেটা চালাতে চালাতেই একসময় শামসের মনে হয়েছে এইসব ঘুমন্ত নিরীহ ছাত্ররা কী করে দেশদ্রোহী হয়? এদের কোন দোষ খুঁজে পায়না সে। ” কখন যেন মনে হয়েছে, এই নিরস্ত্র নিষ্পাপ বাচ্চাদের মারা ওর কাজ না৷ তাই পিছিয়ে গিয়েছিল। এরা তো মাসুম, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। হেলাল যেমন পড়ে পাঞ্জাবে, এরা তেমন ঢাকায়। ছুটিতে গেলে এখনো ওর হাতের উপর ঘুমোয় হেলাল। ওর হাতে না খেলে খিদে মেটে না তার। দরজার আড়ালে লুকিয়ে ভয় দেখায়। খুনসুটি করেই ছুটে যায় আম্মির আড়ালে। আর প্রশ্ন করে বাচ্চারা যেমন করে। এরাওতো হেলালের মতো।” এদেরকে মারবে কেন সে? ভেবেছে বটে, সাময়িক বিরতি নিয়েছে বটে, কিন্তু পরেই আবার উদ্বিপ্ত হয়েছে ‘দেশ’রক্ষার ছলনায়। চালিয়ে গেছে অস্ত্র।
যে চিন্তা চালিয়ে নিয়েছে গল্পটাকে, তা হলো, পাকিস্তানি সেনাদের কারো কারো কাছে, এমনকি যখন তারা নির্মম নৃশংস গণহত্যা চালাচ্ছে, নিশ্চয়ই মনে হয়েছিল অমোচনীয় অন্যায় করছে তারা। নিশ্চয়ই তাদের কারো চোখে পড়েছে একজন প্রশিক্ষিত অস্ত্রধারী সেনা হিসেবে এমন সব মাসুম বাচ্চা ঘুমন্ত ছাত্রদের নিষ্পাপ বুকে গুলি চালানো তার কাজ না। তবু, অন্যায় করছে বুঝতে পেরেও, তারা ঠিকই সেটা করে গেছে। নৃশংসতা তখনই আরো নৃশংস হয়ে ওঠে, যখন জেনে বুঝেই কেউ সেটা আরো বেশি করে করে। স্বাভাবিক মানসিক অবস্থায় থাকা কোনো সেনা চরিত্র দিয়ে এমন একটা বিষয় বোঝানো কঠিন হতো বলেই কি শামস চরিত্রটাকে এভাবে নির্মাণ করেছেন লেখক? তার মন পড়ে আছে হবু বধুর কাছে, পড়ে আছে মায়ের কাছে, যে আঙুলে ট্র্রিগার চাপবে, সেই আঙুলে যন্ত্রণা। তবু হায়েনার মতো মেরে চলেছে ছাত্রদের। বন্ধ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকেই দেখেছে বাচ্চা একটা ছেলে লুকিয়ে আছে গুটিশুটি। তার চোখের উপর অস্ত্র রেখেই, হঠাৎ, মানসিক দোলাচলে থাকার কারণেই হয়তো, স্বাভাবিক সৈনিকের মতো কঠিন প্রতিজ্ঞায় অটল না থেকে, তার মনে পড়ে গেছে প্রয়াত বাবার কথাও। যিনি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সময় উপস্থিত থেকেও বেঁচে গিয়েছিলেন এক হিন্দু প্রতিবেশির সহযোগিতায়। যিনি মরার আগে বহুবার সেই ঘটনা গল্পের মতো করে বলে গেছেন ছেলের কাছে। সেই ঘটনা মনে পড়তেই ছেলে শামসের মনে হচ্ছে যে বাচ্চাটার মুখের কাছে অস্ত্র ধরে রেখেছে সে, সে-ই তার কিশোরবয়সী বাবা, আর নিজে সে কুখ্যাত জেনারেল ডায়ার! আহা, ইতিহাসের দুটি জঘন্য ঘটনাকে কী নিপুণভাবে একসুতোয় গেঁতে দিয়েছেন লেখক এখানে! যাহোক, বাবার কথা মনে পড়ায় ক্ষণিকের জন্য থেমে গেছে শামস, কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে পড়েছে এরা সব ‘হিন্দু বিধর্মী দেশদ্রোহী’, এদের মারতেই হবে, ফলে গুলি চালিয়েছে। গুলির চোটে ছিটকে আসা কোনো ছাত্রের মাথাফাটা ঘিলু লেপ্টে গেছে শামসের মুখে, তার মানসিক দুরবস্থার সুযোগে মুখে জমে থাকা চিটপিটে সেই ঘিলু বমি জাগাচ্ছে। মানসিক দোলাচল আর ট্রিগারচালানো আঙুলের আঘাতের সাথে এই অস্বস্তিটুকু বেসামাল করে দেয় তাকে। কিছুক্ষণ আগেই যাকে সে মেরে ফেলেছে, তার গুলির আঘাতে পড়ে যাওয়ার সময় লোহার গেটে লেগে যে ছেলেটার পেট কেটে ভুড়ি বেরিয়ে গেছে, তাকে দেখে তার মনে হচ্ছে আদরের ছোটভাই হেলাল। আবার মনে হচ্ছে, ভাই না, নিজেকেই মেরে ফেলেছে সে। যে লাশটা পড়ে আসে সামনে তা আসলে তার নিজেরই। আবার মনে হচ্ছে, সে না ছাত্রটাকে মেরেছে বেলুচিস্তানের কসাই রাও ফরমান আলী। তার মনে হচ্ছে তার মা এসে বসে আছে তার লাশের পাশে। মনে হচ্ছে হবুবউ ফাতিমা তার লাশ দেখে হাসছে। হাসছে কেন? এমন কত প্রশ্ন আর ইঙ্গিতই না রেখেছেন লেখক গল্পটায়!
পাকিস্তানি সেনার চোখ দিয়ে এই ঘটনা দেখানো হচ্ছে, দেখানো হয়েছে কত অসার যুক্তির জোরে তারা পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে সেদিন, দেখানো হয়েছে কত নির্মম হলে মানুষ নৃশংস কোনো অন্যায় করছে জেনেও সেটা করা বহাল রাখতে পারে। এই একই বক্তব্য বাঙালির চোখ দিয়ে রক্তে আঁকা অক্ষর দিয়ে বহু উপন্যাসে গল্পে দেখানো হয়েছে, পাকিস্তানি চরিত্রের চোখ দিয়ে তাদেরই করা অন্যায় নৃশংসতা নির্মমতা দেখানো, এ-ই হয়তো প্রথম। অন্যকোণের এই দৃষ্টিভঙ্গিই অন্যচোখে উপন্যাসের উপজীব্য। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বহু কম-আলোচিত সত্যকে এভাবেই অন্য দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখানোর চেষ্টা লক্ষ্য করা যাবে বইয়ের পরবর্তী গল্পগুলোতেও।
“না।
কোনভাবেই নড়া যাবেনা এখন। নড়লেই নড়ে উঠবে এই ঝোপ। ওই পাতা। ওই গাছপালা। তখন ভড়কে যাবে কুকুরটা।আরও ডেকে উঠবে। তাতে আন্দাজ পাবে ও পাশের কুত্তারা। বুঝে ফেলবে কেউ আছে এখানে।তারপর জেগে উঠবে মত্ত বুলেট!”
এভাবেই শুরু হয়েছে ২য় গল্প ‘জন্মদিন’। বন্ধুরা মিলে নাড়ুর জন্মদিন পালন করতে এসেছিল প্রকৃতির মাঝে। কেক কাটার ছুরি ধুতে গিয়ে আর ফেরেনি আসাদ। কাটা হয়নি আর কেক। চারপাশের পৃথিবীটা দুস্বপ্নের মত ভয়ানক ভাবে গুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানিরা। একটা ঘটনার পর থেকে শহীদের বিশ্বাস জন্মায় যত অস্ত্র ই থাক,মানুষ সহজে মারতে পারেনা মানুষকে। কিন্তু আজ এই মানুষের রক্তের ধারা আর আগুনে পোড়া আহাজারিতে সে বিশ্বাস ভেঙ্গে যায়,আয়না যেমন ভাঙ্গে। হলের ছাত্রদের উপর কুকুরগুলোর পাশবিকতার বর্ণনা রয়েছে এ গল্পজুড়ে।
” কিছুক্ষণ পর রুমে রুমে ঢুকল কুকুরগুলো। সঙ্গে হলেরই কয়েকটা ছাত্র।দুজন দুজন করে একেকটা লাশ টানতে টানতে বের হচ্ছে তারা।ক্যান্টিন বয় থেকে শুরু করে শিক্ষক- মরেছে সবাই। কে জানে হয়তো সবচেয়ে কাছের বন্ধুর লাশটাকে টেনে আনছে কেউ।কেউ হয়তো টানছে মৃত ভাইয়ের দেহ। কারও হাতে প্রিয় শিক্ষকের পা।যে পায়ে ভর দিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে জাতির মেরুদন্ড। যে সব পা ছুঁয়ে কদমবুচি করতো ওরা,বেরিয়ে পড়ত শুভ কাজে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে, যে পায়ের ছাপ দেখে পথ চেনে সমাজ,সেসব পা-ই আজ নিঃসাড়। দিকহীন। এভাবে ছেঁচড়ে আনছে লাশগুলো,চামড়া চুমড়া ছিঁড়ছে ,তেমনই হয়তো ছিঁড়ছে বুকটা ওদের।”
এ গল্পের শেষটাতে দেখা যায়, একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ কেও ওদের ‘জয় বাংলা’ মনে হয়। অবলা জন্তুটাকেও ছাড়ে না মানুষরুপী পশুরা।
” তু ভি সেপারেশন মাংতে হো? তু ভি? হা হা হা। লে, সেপারেশন লে জা। গর্জে উঠল হাতিয়ারগুলো।”
এরপর’ দাবানল’, শরণ, মুক্তি, বৈঠা, গুলতি, ঘুম,যুদ্ধ,ঘৃণা,বিজয়,পতাকা প্রতিটি গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক গুলো তুলে ধরেছেন। ভুলি কী করে ‘যুদ্ধ’ গল্পের অভূতপূর্ব উত্তেজনা আর দার্শনিক উচ্চারণ? কিংবা ‘গুলতি’ গল্পের সরল ভীমের অবর্ণনীয় ত্যাগ আর অসম সাহসিকতার কথাই বা বাদ দিই কী করে? অসাধারণ ‘বিজয়’ গল্প পড়াটা তো বিশেষ এক অভিজ্ঞতা হয়েই থেকে যাবে সাথে। ‘শরণ’ গল্পে একজন মায়ের যন্ত্রণার বর্ণনা পড়তে পড়তে দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়েছে। এ গল্পের এক পর্যায়ে দেখা যায় ক্ষুধার্ত এক শিশু যে তার মার কাছ থেকে ছিটকে পড়েছে অনেক দূরে, ক্ষুধার যন্ত্রণা কমাতে এক নারীর উগরে দেওয়া খাবার খাচ্ছে! তার কাছে বমি আর খাবারের কোন পার্থক্য নেই,বা পার্থক্য বোঝার বয়স তার হয়নি। একদিকে সন্তান আর অন্যদিকে মায়ের যন্ত্রনাকে এতটা নিঁপুন হাতে তুলে ধরেছেন লেখক, পাঠকের চোখ ঝাপসা হয়ে উঠবে বারেবার। শরণ গল্পের কয়েকটি লাইন তুলে দেওয়া হলো এখানে,
” বোটা দুটো চেপে ধরল ও। ফিনকি দিয়ে বেরুতে লাগল ভাতরঙা দুধ। একটু পরে শান্তি লাগবে একটু। হালকা লাগবে। কিন্তু ভেতরে যে জ্বলুনি,ছিঁড়ে যাচ্ছে বুকটা যে ব্যথায়,তার কি শেষ হবে কোনদিন? এ বুক কি তার ভরে উঠবে আর?”
সন্তানহারা মায়ের বুকের জ্বালা যে কিছুতেই নেভার নয়।
“মুক্তি” গল্পে রুশির যন্ত্রণার আড়ালে বাংলাদেশের অত্যাচারিত মেয়েদের ও তাদের অসহায় বাবা মায়ের যন্ত্রণার করুণ সুর বেজে উঠেছে।পাকসেনাদের অত্যাচারের কথা পড়তে পড়তে গা শিউরে উঠেছে বারবার। চোখের সামনে যেন ঘটছে সব। আমিও যেন ছিলাম শহীদ, যূথী, নাড়ু, রুশি, গুলতুর মা হয়ে!
‘ঘৃণা ‘ গল্পে এসে আবার দেখা মেলে প্রথম গল্পের সেনা চরিত্র শামসের। বিগত মাসগুলোয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে সে। এত মানুষকে হত্যা করেছে যে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলায় তাকে ভর্তি করা হয়েছে রাওয়ালপিন্ডির সেনা হাসপাতালে। মানসিক ভারসাম্যহীন শামস ফাতিমা আর মায়ের কাছে বলতে থাকে তার করে আসা কুকর্মের কথা। বলে কতজনকে মেরেছে সে, কতজনকে ধর্ষণ করেছে। এই নৃশংস হত্যাকান্ড আর বেসুমার অসভ্যতার কথা শুনে প্রচন্ড ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয় শামসের ভালোবাসার ফাতিমা ।
স্বাভাবিকভাবেই আমরা পাকিস্তানিদের ঘৃণা করি, কিন্তু তাদের কৃতকর্মের জন্য এমনকি তাদের ভালোবাসার মানুষরাও কেউ কেউ ঘৃণা করছে, এটাই কি গল্পের বক্তব্য? তা হলে এ যেন সত্যিই অন্যচোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধকে।
শেষ গল্পটি ‘পতাকা’। এদেশের অনেক সুবিধাবাদী মানুষ ধর্মের আড়ালে পাকিস্তানি কুকুরগুলোর সাথে মিশে যে জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়েছে আবার সুযোগ বুঝে ভোল পাল্টেছে সেটাই এই গল্পের বক্তব্য। যুদ্ধ শেষের পথে, আমাদের মহান বিজয় আসন্ন। গা-ঢাকা দিতে শুরু করেছে রাজাকারেরা। পালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি সেনারা। তাদের কথা বলতে গিয়ে লেখক বলছেন, “আত্মসমর্পণই হয়তো করবে কাপুরুষগুলো। তারপর উড়ে যাবে লেজ গুটিয়ে। কিন্তু এই রাজাকার আর প্রতারকরা তো থেকে যাবে। থেকে যাবে জন্তুদের চিন্তার বীজ আর পাশবিকতার জীবানু বুকে ধরে। প্রচন্ড ধুরন্ধর আর সুযোগ সন্ধানী এরা। কত মুখোশ নিয়ে যে ঘোরে। “
সেই মুখোশ পরেই যে স্বাধীনতাবিরোধীরা বুকে পাকিস্তানি পতাকা এঁকেও সামিল হয়েছে বাংলার বিজয়পতাকার নিচে, তারই স্বাক্ষ্য হয়ে আছে পতাকা নামের এই গল্প। যার শেষ লাইনটা এ সময়েও বড় বেশি সত্যি, ধাক্কা লাগল যেন, কেঁপে উঠলাম!
” যুদ্ধ শেষ হয়নি। হয় না”।
শব্দঘর- অন্যপ্রকাশ এর তরুণ কথাশিল্পী – অন্বেষণ কার্যক্রমে নির্বাচিত প্রথম সেরা উপন্যাস ‘অন্যচোখে ‘ সত্যিই আমার পড়া অন্যতম সেরা একটি উপন্যাস। তবে গল্পগুলোর যোগসূত্র কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুবই সূক্ষ্ণ, অনেকের পক্ষেই ধরা কঠিন হবে। সূত্রগুলো আরো একটু জোরালো হলেই ভালো হতো মনে হয়েছে। কিছু কিছু চরিত্র আরো খানিকটা বিস্তৃতি ও মনোযোগ দাবী করে।”
২১ মে, ২০১৯

৩. গল্পকার হুসাইন হানিফ এর আলোচনা

অন্যচোখে: যে পথে হাঁটেনি কেউ 

প্রবেশপথ
অপারেশন সার্চলাইটের রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে যে লাশটা পড়ে থাকবে, সে হয়তো আমি, কিংবা আমার জননী; অথবা প্রিয়তম পিতা; অথবা স্নেহের ছোট ভাই, অথবা একমাত্র আদরের ছোট বোন, কিংবা ঠোঁটে তিল চিহ্ন আর হাতে নীলখামে গোপন চিঠি নিয়ে অপেক্ষারত ভালোবাসার মানুষটি: যেকেউ হতে পারে যুদ্ধের বলি, মূলত একটি লাশ; কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আর লাশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে যে, কিংবা যে খুনি, সে আমি কিংবা তুমি অথবা সে; ঊনিশশ একাত্তর সালের পঁচিশে মার্চ রাতে আমরা সবাই, অথবা সে সময়ে বেঁচে থাকা যে কেউ পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে একটা ভয়ঙ্কর সময়ের চিহ্ন বয়ে নিয়ে হলেও হতে পারতাম চোখ ঠিকরে বেরিয়ে যাওয়া বা মগজ গলে চুইয়ে পড়া একেকটা বীভৎস লাশ। হতে পারতো জিঘাংসায় মানুষের রক্তপানে উল্লাসরত একেকটা খুনি, মানুষরূপী রাক্ষস, ভয়ঙ্কর দানব।

সেই সময়টাতে আমরা যদি বাঙালি হই অবধারিত রূপে আমাদের অবস্থান বিভক্ত হয়ে পড়বে একজন প্রতিবাদী অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে; সাধারণ জনগণের চেহারা নিয়ে, যারা মার খেয়ে যাবে দিনের পর দিন; অথবা এর সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থাৎ রাজাকার পরিচয়ে, যারা ধর্মান্ধতার আড়ালে কিংবা বিগত দিনে দেশের অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্য নিজেদের আন্দোলন আর ভালোবাসার মোড়কে অথবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে, অবশ্য এর সম্ভাবনা কম থাকলেও আছে যেহেতু বিরোধিতা করে যাবে একটা দেশের বিরুদ্ধে, যেটা স্বাধীন হতে চলেছ। একটা নতুন দিনের জন্য, যেটা ফলত অবশ্যম্ভাবী; আর শাসক শ্রেণী, শোষণ করে চলেছে যারা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি, এভাবে এসব বিবিধ বিভক্তিতে দেশের মানুষ অবস্থানগত জটিলতায় পড়ে ভাগ হয়ে যায় যার যার পরিচয় নিয়ে। এই পরিচয়ের জটিলতাকে ভিন্নভাবে দেখার প্রয়াস অন্যচোখে।

অর্ভ্যথনাকক্ষ
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে উপন্যাস লেখার শুরু বাংলায়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে থেকেই; সেই ১৯৭১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কত শত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই বেরিয়েছে তার হিসাব করা শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভব। এতসব বই লেখা হয়ে গেলেও, যেটা বাদ ছিল, যে পথে হাঁটেনি কেউ। একজন আশান উজ জামানের জন্য অপেক্ষা করে ছিল যে পথ। পাকিস্তানিদের অর্থাৎ বিরুদ্ধশক্তির সচেতন মানুষদের দৃষ্টিতেও পাকিস্তানিদের নৃশংসতার বিরুদ্ধে বাঙালিদের যুদ্ধটাকে বৈধ শুধু নয় দায়িত্ব বলে দেখানো। আরও বিশদ করে বলতে গেলে সবাই প্রত্যাশা ছিল, কী করে ভিন্ন একটা পথ আবিষ্কার করা যায়, মুক্তিযুদ্ধটাকে, দেশের একজন হয়ে, আরও গুছিয়ে পরিপাটি করে কোনো কমতি না রেখে কিভাবে উপস্থাপন করা যায়, গতানুগতিক ধারায় না গিয়ে নতুন একটা ফর্ম আবিষ্কার করে উপন্যাস লেখা, এসবই ছিল দুঃসাধ্য; হয়তো ভেবে ছিল অনেকেই, কিন্তু সেই ভাবনা আকার পায়নি কারও হাতে। অপেক্ষায় ছিল কোনো এক দৈবের, যদিও দৈবে লেখা হয় না; তবু একটা সময়ের আগেই কেউ লিখতে চায়নি হয়তো; কিন্তু, আশান উজ জামান; না, দেরি করেননি কোনো দৈবের জন্য, ধার ধারেনি কোনো নিয়ম আর নিয়তিনির্ধারকের গৎবাঁধা নীতিকে; সব প্রচলনকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেই ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে ‘অন্যচোখে’ নিয়ে নিজের উপস্থিতির ঘোষণা করেন একজন আশান উজ জামান; তার ক্ষেত্রে এ বাক্য ভালোভাবে প্রযোজ্য- তিনি এলেন এবং মঞ্চ দখল করলেন।

এখানে বলে রাখা ভালো অন্যচোখে ‘শব্দঘর-অন্যপ্রকাশ-এর কথাশিল্পী-অন্বেষণ কার্যক্রম:১’ এর সেরা উপন্যাস হিসেবে মনোনীত হয়েছিল।

বিশেষ অতিথিদের ভাষণ
হাসান আজিজুল হক: আমি খুব আগ্রহ নিয়ে উপন্যাসটি পড়লাম, তরুণদের লেখা সম্বন্ধে আশান্বিত হয়ে উঠলাম। এই উপন্যাসের বিষয় হলো মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু এ উপন্যাসে দেখা যাচ্ছে যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এবং পাক-হানাদারের সহযোগিতা করে আলবদর, আলশামস এবং রাজারকার ইত্যাদি আখ্যায় আখ্যায়িত হয়েছিল, মানুষ হিসেবে বিচার করতে গেলে তাদেরও সংসার-পরিবার-আত্মীয়স্বজন তার লেখায় উঠে এসেছে। তখন মনে হয় আমরা নকশিকাঁথার দিকটা এতদিন দেখে এসেছি, তার উল্টো দিকটা আমাদের চোখে পড়ে নেই। প্রকৃতপক্ষে শিল্পের জন্য যে-পরিপ্রেক্ষিত উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হবে তার একপেশে বিবরণে কোনো মহৎ শিল্পসৃষ্টি হতে পারে না। এই প্রথম আমরা লক্ষ করলাম, একজন তরুণ কথাশিল্পী মুক্তিযুদ্ধের এপিঠ-ওপিঠে আলো ফেলে প্রণিধানযোগ্য এক অগ্রসর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

জাকির তালুকদার: আপনার ছোট আয়তনের উপন্যাস অন্যচোখে আমি পাঠ করেছি। বোঝা যাচ্ছে যে, আপনি এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চিহ্নিত হলেও, আপনার এক ধরনের প্রস্তুতি আছে কথাসাহিত্যে কাজ করার। আপনি প্রস্তুত হয়ে এসেছেন। আপনার আখ্যান-বয়ন, শব্দ নিয়ে কারুকৃতি, চরিত্রগুলোকে স্বল্প আয়তনের মধ্যেই চরিত্র করে তোলার শক্তি দেখে বোঝা যায় লেখালেখি নিয়ে আপনি অনেকদিন ধরেই ভাবছেন এবং অনুশীলন করছেন।

আমরা সমকালের প্রচলিত চিন্তার পরিধির বাইরে যেতে ভয় পাই। কেননা মধ্যবিত্ত-মানস আর যাই হোক, চিন্তার বিপ্লবকে খুবই ভয় পায়। আমাদের ভাষার লেখকদের এক জায়গাতে আটকে থাকার পেছনের কারণও প্রধানত এটাই। যারা আমাদের সাহিত্যের মোগল, তারা নিজেরা যেহেতু এর বাইরের কোনোকিছু ধারণ করতে অক্ষম, তাই অন্য সবার ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে তারা চেষ্টা করেন সবাইকে বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ার জন্য বাধ্য করতে।

কথাসাহিত্যের শক্তির গোড়ায় ঘুণ ধরিয়ে দিয়েছে বিনোদন-চিন্তা। অনেক বড় বড় চেয়ারে বসে থাকা কথাসাহিত্যিক সাহিত্যকে বিনোদন বলেও মনে করেন। সভা-সমিতি-বেতার-টিভিতে বলেও থাকেন এই ধরনের কথা। আমি সবিনয়ে, কখনো দুর্বিনীতভাবে, তাদের প্রতিবাদ করি। বিনোদন নয়, শব্দটি হতে পারে আনন্দ। ব্রহ্মস্বাদ সহোদরম। আপনার উপন্যাসটি পড়ে মনে হয়েছে আপনি আনন্দ আর বিনোদন এর পার্থক্য বোঝেন। এটাই আপনার প্রধান শক্তি।

মোহিত কামাল: উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় বাঙালির গাঢ় রক্তে রাঙানো মুক্তিযুদ্ধ। আখ্যানটি মাথা তুলেছে লাশের স্তূপ থেকে। সেই স্তূপ, যার ওপর ভর দিয়ে পর-সকালেই উদিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলার সূর্য। সেই সূর্যের সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে গেছে কাহিনী। ষোলোই ডিসেম্বরের উদ্দেশ্যে। এর চরিত্র হয়েছে মরণপণ স্বাধীনতাকামী বাঙালির দুর্দশা, লোমহর্ষক নারীধর্ষণ, মৃত্যু, সাহস, ঘুরে দাঁড়ানো, কারও কারও কাপুরুষতা আর পাকিজন্তুদের তাণ্ডবসহ মুক্তিযুদ্ধ স্বয়ং। বাতাসে বাতাসে অত্যাচারের আগুন। আগুনের মুখে আর্তনাদের ধোঁয়া। ধোঁয়ার গায়ে মৃত্যুর ঘ্রাণ। মুক্তিযুদ্ধকালীন সব অস্থিরতা নিয়ে সে-সময়ের উদ্বাস্তু বাংলাদেশ যেন রূপ পেয়েছে উপন্যাসটির অবয়বে।

হামীম কামরুল হক: আশান মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস লিখেছেন এটা বলার চেয়ে বলা দরকার তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে তার যাত্রা শুরু করেছেন। অন্য আরও বিষয় দিয়েও সেটি হতে পারত। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের কোনো রকম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকার পরও তার এই উপন্যাস পড়লেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার প্রাকৃতিক, সামাজিক ও মনোজাগতিক জগৎ জেগে ওঠে না কি? বলা যেতে পারে, উপন্যাসের গদ্য বা ভাষায় তার ততটা দক্ষতা এখনো আসেনি, যখন বলা যেতে পারে, সেই ভাষাকে তিনি উদাত্ত, উন্মুক্ত ও উন্মাদ করে দিলেও উপন্যাসের কোথাও কোনো ভারসাম্য হারাবেন না, সেই পর্যায়ে তিনি উঠে আসেননি। অর্থাৎ তার ভাষাগত দক্ষতা এখানে সর্বত্র তাল সামলাতে পারেনি।

ধন্যবাদান্তে
এখানে সবাই উপন্যাসটির ইতিবাচক দিক তুলে ধরেছেন। শুধু একজন বিশেষ অতিথির ব্যাপারে আমরা সেটা বলতে পারব না, ব্যাপারটা সেরকম না; তবে তিনি ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেছেন, সঙ্গে তার যে নেতিবাচক দিক, সেটাও তুলে ধরতে ভুলে যাননি। এদিক থেকে হামীম কামরুল হক প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। কেননা, সাহিত্যের পর্যালোচনা সব দিক থেকেই তার ওপর আলো ফেলার কথা বলে। তবে তিনি যে নেতিবাচক দিক বা গদ্য নিয়ে বা ভাষাগত অদক্ষতার কথা বলেছেন, সে বিষয়টা আমাদের ভেবে দেখতে হবে। ব্যাপারটাকে যদিও আমি একটু আগে ব্যাখ্যা করেছি, ভাষাগত উন্মুক্ততা বা উদাত্ততা, সেটা আরেকটু ভালো করে বলতে হবে। আমরা যারা সচেতন পাঠক তাদের এ কথা অজানা নয় যে রাবীন্দ্রিক গদ্য, ট্রাডিশনাল গদ্য, হুমায়ূনীয় গদ্য, জহিরীয় গদ্য, ইলিয়াসীয় গদ্য আরও বিবিধ সব গদ্য-ধারা বিদ্যমান। এইসব গদ্য ধারার কোনোটার সঙ্গে আশান উজ জামানের গদ্য মিলছে কি না? যদি না মিলে থাকে তবে তো আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতেই হয় যে সে আসলে এই সমস্ত ধারার বিপরীতে গিয়ে স্বতন্ত্র একটা ধারা গড়তে চেয়েছে। এই ধারা গড়তে গিয়ে সে সফল না ব্যর্থ, সফল যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না, সেই প্রশ্নে না গিয়ে আমাদের ভাবা উচিত হামীম কামরুল হকের তোলা প্রশ্নটি নিয়ে। ভাষাটাকে যদি উদার উন্মুক্ত করা হত তবু তার ‘ভারসাম্য’ হারাবে না; তার মানে কি এই নয় যে, ভারসাম্য এখনো ঠিক আছে; তবে যদি তিনি অন্যভাবেও লিখতেন তবে সেটাও সম্ভব হতো বলে মনে হয়। আমাদের জানা কথা, যেকোনো সফল শিল্পকর্ম তখনই সফলতার দাবি করে, যখন সে আরও দশটা ভাবের জন্ম দেয়; তার আরও সম্ভাবনার কথা মনে করিয়ে দেয়। এখন আমরা হামীম কামরুল হকের প্রশ্নের আলোকে এ কথা বলতেই পারি, সে দিক থেকেও ‘অন্যচোখে’ সফল একটি শিল্পকর্ম।

ভাষাগত যোগ্যতায় উঠে এসেছেন কি না, সেই ব্যাপারটাও ভেবে দেখা দরকার। একটা কাজ যদি কেউ দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে, আরেকটা যে সে পারবে না সেটা কিন্তু না। অর্থাৎ দাঁড়িয়ে যে আছে সে বসতে পারবে ঠিক; তবে বসে যে আছে, সে যে দাঁড়াতে পারবে না, এমন বলা যাবে না। যার যার অবস্থান নিয়ে সে থাকবে। কেউ জোরে চললে তাকে তার মতো চলতে দাও; কেউ আস্তে চলে আনন্দ পেলে, তাকে আস্তে চলতে দাও। যে যেতে রাজি নয়, তাকে থাকতে দাও। মোট কথা ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’। সে কেমন হবে না হবে সেটা তার ব্যাপার। সে যে অমন হতে পারবে না, তা না; হতে পারবে বলেই যে তাকে অমনটাই হতে হবে, এমন তো না।

আর ‘অন্যচোখে’ উপন্যাসটির যেকোনো জায়গা থেকে এক স্তবক টেনে নিয়ে যদি শুধু দাঁড়িগুলো তুলে দেওয়া যায় তাতেই বোঝা যাবে বাক্যের গতি বা ভাষাগত উদারতা আছে কি না: ‘আমাদের বাঁওড়ের তলায় নাকি একটা দেশ ছিল, সোনার দেশ: ঘরবাড়ি দালানকোঠা সবই সোনার; সেদেশের লোকজন খুবই ভালো আর দয়ালু আর উপকারী: চাইলেই তারা মানুষকে সাহায্য করত; তবে চাইতে হতো কায়দা করে: যেমন কেউ হয়তো খুব গরিব, মেয়ের বিয়ে দিতে পারছে না বা চিকিৎসা করাতে পারছে না বা ঘরবাড়ি নেই কোথায় কোথায় থাকে; সে যদি সাহায্য নিতে চায়, তাহলে তাকে বাঁওড় কান্দায় গাব গাছটার নিচে যেতে হবে সন্ধ্যার সময়, পুবদিকে মুখ করে চোখ বুজে দাঁড়াতে হবে; তারপর প্রয়োজনটা বলতে হবে, মুখ ফুটে না মনে মনে; অনুরোধ করতে হবে সোনার দেশের রাজার কাছে; লোকটা যদি লোভে পড়ে মিথ্যেমিথ্যি ওসব চায়, তাহলে পাবে না; কিন্তু সত্যিই যদি তার দরকার হয়, তা হলে যখন সে গোসল করতে যাবে, বা মাছ ধরতে বা কাপড় কাচতে, দেখা যাবে তার পায়ে একটা আংটি এসে ঠেকল বা বালা বা নোলক- এগুলো হলো দান- ফেরত দিতে হবে না; শুধু ধন্যবাদ দিলেই হবে।’

খাদ্য-তালিকা
১. সংক্রান্তি
২. জন্মদিন
৩. দাবানল
৪. শরণ
৫. মুক্তি
৬. বৈঠা
৭. গুলতি
৮. ঘুম
৯. যুদ্ধ
১০. ঘৃণা
১১. বিজয়
১২. পতাকা

রেসিপি
উপন্যাসটি যে ধারায় তৈরি হয়েছে, তা আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে। এই ধারাটি বাংলা ভাষায় প্রথম। প্রথম বলেই অনেকেই অস্বীকার করার মওকা পেয়ে গেছেন একে উপন্যাস না বলার। আমাদের চোখে পড়েছে একে গল্পের বই বলে দাবি করার চেষ্টা।

আমরা একে উপন্যাস হিসেবেই মেনে নেব। উপন্যাসের গল্পগুলো একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করে এগিয়ে গেছে নিজেদের লক্ষ্যে। মাঝে মধ্যে একে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হলেও, শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকের অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। তবে তাদের সবার ভেতর যে মিলটা পাওয়া যায় তা যুদ্ধ। অর্থাৎ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে এদের সবার আনাগোনা। ব্যাপারটা যেন সৌরজগতের মতো। সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে অন্য সব গ্রহ নক্ষত্র। অবশ্য সূর্যও ঘুরছে। অর্থাৎ যার যার কক্ষপথ ঠিক রেখে তারা নিজেদের মতো করে ঘুরছে। সব মিলিয়ে যেন একটা সংসার। পরিবারের প্রধান কর্তাকে মান্য করে চলে অন্য সব সদস্য। অন্য সদস্যদের উপেক্ষা করে প্রধান তার কার্য পরিচালনা করতে পারবেন না।

এখানে সময়টা বুঝে নেওয়া গেলেও স্থানের ব্যাপারে মাথা খাটানো ছাড়া উপায় নেই। গল্পগুলোর ব্যবহারিক আঞ্চলিক ভাষার সাহায্যে অনুমান করে নেওয়া যেতে পারে কে কোথায় আছে, বা গল্পটি মূলত কোথায় ঘটিত।

২২ মে ‘ম্যান বুকার আন্তর্জাতিক পুরস্কার ২০১৮’ পুরস্কার পেয়েছেন পোলিশ কথাসাহিত্যক ওগলা তোকারচুক। তিনি নিজের উপন্যাসের ব্যাপারে বলতে গিয়ে এই কথাগুলো যখন বলেন তখন কি আমাদের অন্যচোখের কথা মনে পড়ে না?- ‘উপন্যাসটির ফর্ম বা ধারার কারণেই বিচারকেরা একে বেশি পছন্দ করেছেন। পুরো উপন্যাস খণ্ড খণ্ড অংশ, গল্প বলায় কোনো ধারাবাহিকতা নেই, চরিত্রগুলোর সবারই একটা তাড়া নিজ নিজ অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার বিষয়ে। উপন্যাসের গল্পগুলো গতি ভালোবাসে, স্থিতি নয়। তাই আমি ফ্লাইটসকে বলি ‘নক্ষত্রমণ্ডল উপন্যাস’। এতে আমি বিভিন্ন জনের ভিন্ন ভিন্ন গল্প একটি কক্ষপথে ছুড়ে দিয়েছি। এবং সেগুলো কুণ্ডলী পেকে একটা উপন্যাসে রূপ নিয়েছে। গল্পগুলো আলাদা আলাদা; কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না চরিত্রদের সবাই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে বদ্ধপরিকর। এই একমাত্র মিল গল্পগুলোকে উপন্যাসে পরিণত করেছে।’

আর মনে পড়ে বলেই যে তিনি ওটার প্রভাবেই এমনটা লিখেছেন, যেহেতু আমাদের অনেকের ভেতর প্রভাব খোঁজার একটা বাতিক আছে, পুরস্কার পাওয়ার ১০ বছর আগেই যেহেতু উপন্যাসটি রচিত, সেহেতু কেউ ভাবতেই পারেন- ব্যাপারটা এমন ভাবা যাচ্ছে না; কেননা, পুরস্কার পাওয়ার আগে সেটা বাংলাদেশে কারও কাছে এসেছে এটা প্রায় অবিশ্বাস্য না হলেও, ইন্টারনেটের যুগ যেহেতু, এসেছিলই যে তা হলফ করে বলা যাচ্ছে না; আর তাছাড়া ওটা তখন মূল ভাষা পোলিশেই ছিল, অনুবাদ হয়নি; অনুবাদ হলো এই সেদিন; আশান উজ জামান সেই ভাষা জানেন কি না, সেটাও আমাদের জানা নেই; আর যদি জেনেই থাকেন, সেটাও আমাদের জন্য মঙ্গল বৈ নয়; কেননা, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেখাগুলোর সঙ্গে পরিচিত এত জানাশোনা, এবং বিশ্বমানের লেখা উপহার দেওয়া একজন লেখকও আমাদের বাংলাভাষায় আছে এটাও একটা বিস্ময়েরই ব্যাপার।

ভোজনপর্ব
এযাবৎ, খেয়াল করে দেখলে, সচেতন দুয়েকজন লেখক: মাহমুদুল হক ও রশীদ করিমসহ আরও কয়েকজনের নাম নেওয়া যেতে পারে। তারা বাদে, প্রায় সবাই যুদ্ধের সংখ্যার হিসাব নিয়ে ব্যস্ত হয়েছেন, যুদ্ধের ছবি আঁকতে গিয়ে সেখানে ধরা পড়েছে অনুদান পাওয়ার কাঙালিপনা; কিন্তু ‘অন্যচোখে’ সংখ্যার হিসাব নয়, আশান দেখাতে চেয়েছেন জীবনের যন্ত্রণা। একটা জীবন কী ভীষণরকম যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়ে যুদ্ধের বলি হলে; তখন সেই একটা জীবননাশও সমর্থন করা অসম্ভব, আর তো এক দুই নয় ত্রিশ লাখ মানুষের প্রাণের কথা।

প্রত্যেকটা চরিত্রের বর্ণনা আর কাহিনী খুবই স্পর্শকাতর, ভয় ধরানো, মায়াজাগানো, ঘুম কাড়িয়ে নেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর। উপন্যাসটাকে ব্যাখ্যা করতে গেলে এর প্রতিটা চরিত্র নিয়েই আলোচনা করতে হবে। কারণ, এখানে কোনো চরিত্রই মুখ্য নয়; আবার কোনো চরিত্রই নয় গৌণ। নায়ক বা ভিলেন বলে আলাদা কারও কোনো জায়গা এখানে নেই। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ কত কীই না করে; চুরি করে হলেও পরিবারের দায়িত্ব পালন করে চোর; এখানে একদিকে তার অপরাধ অপর দিকে তার ভালোবাসা। এটা বলা মূখ্য নয় যে অপরাধ কোনো ব্যাপার না; মূলত এইসব জীবনেরই অংশ। নিষ্ঠুরতা, যৌনতা, অপরাধপ্রবণতা; এগুলো মানুষের স্বভাবজাত; কিন্তু এগুলো যখন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন অন্যসব মানুষ, যারা নিজেরাও এইগুলো দ্বারা চালিত। তারাও প্রতিবাদ না করে পারে না। সবকিছুর একটা সীমা আছে। সেই সীমাটা হচ্ছে বিবেক। সেই বিবেক ধরে টান মারার দক্ষতা আশান উজ জামানের আছে। এখানে প্রত্যেকটা গল্প বিবেককে দংশন করে ছাড়ে। গল্প বলার দক্ষতা, চরিত্রচিত্রণের পারঙ্গমতা, শব্দ-প্রয়োগের সিদ্ধহস্ততা আর ভাষার কারুকার্য নিয়ে যে কুশলতা তিনি দেখিয়েছেন সেটা বলে আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না; বড়রা আগেই বলেছেন এসব।

বিদায়ের আগে
তবে একটা ব্যাপারে কথা না বললেই নয়: আশান উজ জামান তার ‘অন্যচোখে’ মনের ভাব প্রকাশের জন্য মাঝেমধ্যে গালি ব্যবহার করেছেন। এটা যদিও বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঠিক ধরে নেওয়া যায়, তবু আমাদের বলতে ইচ্ছে করে, তিনি এই ব্যাপারটা না করলেও করতে পারতেন। পাকিজন্তু, হায়েনার দল, এইসব শব্দ ব্যবহার পুরোপুরি ঠিক; তবে এগুলো এড়িয়ে যদি তিনি চলতে পারতেন, তবে যে সোনায় সোহাগা হতো সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, তিনি লেখক; তার কাজ বর্ণনা করা, যেই সময়ের জঘন্যরকম ঘটনাবলি এসে গেছে, সেগুলো পাঠক পড়ে আপনাতেই গালি দিয়ে উঠবে, লেখকের আলাদা গালি দেওয়ার দরকার নেই।

বাহিরপথ
সচেতন লেখকরা সবাই যখন একটা বৃত্তের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করছে, যদিও তারা মনে করছে ভিন্ন কিছুই তারা করছে, কিন্তু ফল যা আসছে, তা থেকে এটাই প্রমাণিত, তাদের প্রত্যেকের চেষ্টাই একটা বৃত্ত তৈরি করছে, সেই বৃত্তে সবাই ঘুরে চলেছে সমান তালে; কিন্তু আশান উজ জামান বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন সেই বৃত্ত থেকে। নিজের জন্য আলাদা বসত তৈরি করে নিয়েছেন, স্বতন্ত্র ভাষা, আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি; যেটা মূলত সিরিয়াস লেখকদের বৈশিষ্ট্য, সেটা আশান উজ জামানের আছে। এই আলাদা জিনিস বা নতুন ব্যাপারটাকে মেনে নেওয়ার মতো মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

আর উপন্যাসের শেষ বাক্য দু‘টি আমাদের লক্ষ করতে হবে। ‘যুদ্ধ শেষ হয়নি। হয় না।’ যুদ্ধ শেষ হয়েও কেন শেষ হয়নি; বা হয় না; তা কি এ জন্য যে, সমস্ত বিপ্লবই এক সময় গার্হস্থ্যের দিকে মোড় নেয়? তার ব্যাখ্যা আমরা আশান উজ জামানের কাছেই জানতে চাইব। আরেকটি অভিনব রচনা দিয়েই যেন তিনি এই প্রশ্নের বা তার নিজের বলা কথার ব্যাখ্যা দেন।”

জুলাই ২১, ২০১৮

**

২. সাগর মল্লিকের পাঠপ্রতিক্রিয়া

আসুন একটু দৃষ্টি বদল করি। একই জিনিসকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখি। সহজ উদাহরণ দিতে গেলে বলতে হয়, শেখ মুজিবকে বাঙালী যতই স্বাধীন দেশের রূপকার বলুক পাকিস্তানি মাত্রই বলবে দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক। আসুন এবার মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলোকে একটু দৃষ্টি বদল করে দেখি। কি? দেখতে সমস্যা হচ্ছে? আমার কাছে সহজ উপায় আছে। নতুন কথাসাহিত্যিক উজ জামানকে চেনা আছে? ওনার অন্যচোখে খুলে বসুন। প্রথম কয়েক পাতায় বর্ণনা করা আছে পঁচিশে মার্চের কালো রাতের কথা। কিন্তু বাঙালির চোখে নয়, একজন পাকিস্তানি সৈন্যের চোখে। একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসকে দেখি। গল্পগুলো একই রকম, শুধু অনুভূতি গুলো অজানা। সেই ভিন্ন অনুভূতির আবহাওয়া পেতে পড়তে হবে এই অন্যচোখে।
আমি সাধারণত একটু দেখেশুনে বই পড়ি। বইয়ের শেষে একগাদা বইয়ের রেফারেন্স দেখে মনে হলো পড়া যেতে পারে। তো পড়তে শুরু করলাম। লেখার আভাসে বোঝা যাচ্ছে খুব খেটেখুটে লেখা। অনেক তথ্য আছে, জ্ঞান আছে, আর অনুধাবনের একটা বিষয় আছে। অনেকটা সৃজনশীল প্রশ্ন এবং উত্তরের মতো। ছোটছোট কথায় অসাধারণ অভিব্যক্তি। লেখকের এই জিনিসটা মন কেড়েছে খুব। প্রতিটি লাইনের আবার এক লাইন করে উপমা। আহা!
উপন্যাসের শুরু, থুক্কু গল্পের শুরু,, থুক্কু, বইটিকে গল্প বলবো নাকি উপন্যাস এটা নিয়ে আবার বেশ খটকা আছে। সে যাই হোক, উপন্যাস যখন উপন্যাসই বলি। উপন্যাসের শুরুতে ভিন্ন চোখে দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকে। প্রতিটি গল্পই খুবই সাধারণ কিন্তু ভিন্নচোখে দেখানো হয়েছে প্রেক্ষাপট। একজন শিশু, একজন নারী, একজন ছাত্র, একজন সাধারণ মানুষের চোখে মুক্তিযুদ্ধের সাধারণ চিত্র চিত্রিত হয়েছে এখানে। আরেকটু সহজ করে বলি, এখানে বারোটি ভিন্ন-ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন-ভিন্ন গল্পকে ভিন্নচোখে দেখানো হয়েছে। একজন পাকিস্তানি সৈনিক অপারেশন করছে তখন তার অনুভূতি কেমন, একজন ছাত্র যখন দূর থেকে দেখছে হত্যাযজ্ঞ তখন অনুভূতি কেমন? একজন ছোট বাচ্চা সে তখন কি ভাবছিলো, একজন সাধারণ নারী, একজন সাধারণ মানুষের অনুভূতি কেমন ছিলো রাজাকারের বিরুদ্ধে? গল্পগুলো ভিন্ন কিন্তু একই সুতোয় বাঁধা।
আমি বইয়ের কাহিনী কিংবা সারসংক্ষেপ নিয়ে আলোচনা আগাবো না। কারণ তা পড়লে পাওয়া যাবে, আর বলতে গেলে একটা উপন্যাসের নয় বারোটা গল্প নিয়ে আলোচনা করতে হবে। তবে মোটামুটি কি ধরনের লেখা আছে তার একটা স্পষ্ট ধারণা দিয়েছি। তবে বইয়ের শুরু এবং শেষটা মারাত্মক সুন্দর। আর মধ্যের অংশ ম্যাড়মেড়ে সুন্দর।
আমি একজন ভাল লেবেলের নিন্দুক। নিজের প্রবৃত্তি দমন রাখা দুষ্কর। পরিশেষে একটু নিন্দে করে যাই, লেখক মহাশয় গল্প লিখেছেন নাকি উপন্যাস লিখেছেন সেটা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। হয়তো আপনিও পারবেন না। ঠিক গল্প নয়, আবার উপন্যাসও নয়। গল্পে কোনো টুইস্ট নেই, উপন্যাসের মতো জীবনের কথাও বলে না। তবে বারোটি গল্পকে যদি একই ধারাবাহিকে মেলানো যেত তবে বইটা মারাত্মক লেবেলের সুন্দর হতো। লেখক এখানে এমনি চেয়েছেন নাকি কম খেটেছেন বোঝা মুসকিল। তবে লেখার মধ্য যে একটা শক্তি আছে তা নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে বাধ্য হবে প্রতিটি পাঠক।

**

১. অনন্য গাঙ্গুলি’র পাঠপ্রতিক্রিয়া

“অন্যচোখে যতটা না মুক্তিযুদ্ধের গল্প, তারচেয়ে বেশি জীবন আর মৃত্যুর গল্প; মৃত্যুর পাহাড়ের মাঝে জীবনের আশায় বুক বাঁধা মানুষের গল্প। ঐ অদ্ভুত অশান্ত সময়টাতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের চিন্তা- ভাবনাগুলো প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন লেখক। রাজাকারদের হাতে ধরা পড়া একজন মুক্তিযোদ্ধার মানসিক অবস্থার পাশাপাশি পঁচিশে মার্চ রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালানো এক পাকসেনার ভাবনা কিংবা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের এক সাধারণ তরুণের ধারণা কেমন ছিল- সে সম্পর্কে একটা ধারণা দিতে চেয়েছেন তিনি।

বইটা উপন্যাস হিসেবে কেন প্রকাশিত হয়েছে সেটা আমার কাছে পরিষ্কার না- গল্প সংকলন হলেই মানাত ভালো। বইয়ের কাঠামোটাও সেরকমই, এবং দু-একটা চরিত্রকে একাধিক গল্পে দেখা গেলেও প্রতিটা অধ্যায়ই স্বয়ংসম্পূর্ণ।

আরেকটা কথা- এই বইমেলার যতগুলো মৌলিক বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টোনোর সুযোগ হয়েছে আমার, তার মধ্যে একমাত্র নন-হুমায়ূনীয় বই এটা। বলছি না হুমায়ূন আহমেদকে অনুসরণ করা খারাপ, কিন্তু সামগ্রিক ভাবে সাহিত্যে বৈচিত্র্য দরকার- সেটাও কেউ অস্বীকার করবেন বলে মনে হয় না। হুমায়ূন আহমেদের- এবং তাঁর অনুসারীদের- লেখার স্টাইল অনেকটা সোজাসাপ্টা, বর্ণনামূলক- তাতে অলঙ্কারের ব্যবহার কম। এই ধরনের লেখা পড়ে মজা আছে, কিন্তু একই ধরনের প্লট ও ধাঁচের বই পরপর আর কত পড়া যায়? সেখানে “অন্যচোখে” বইটায় জহির রায়হান, শওকত ওসমান বা হাসান আজিজুল হকের লেখার ক্ষীণ ফ্লেভার পেয়েছি। তবে তার চেয়েও বড় কথা, লেখক নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত সেই স্বকীয়তা বজায় রাখতে পেরেছেন।
পরবর্তী বইয়ের জন্য অপেক্ষায় আছি।

৪.৫/৫”

১৬ এপ্রিল, ২০১৮

**

[লেখকদের অনুমতিক্রমে সংরক্ষণ করা হলো]