আশান উজ জামান

দেখা। লেখা। পড়া

কৃতীর কোমরে মাদুলি।
মানতে কষ্ট হচ্ছে। আমাদের মধ্যে সবচে’ বিজ্ঞানমনস্ক ও। অথচ তাবিজ রাখে!
মমকে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না। তলপেটে ভুড়ির শহর। আবার ওর জিরো ফিগারের গুমোরে বাঁচা দায়!
শ্রেয়াকে বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেখি প্রতিদিন। অথচ কী শুকনো ভেতরে ভেতরে! কীভাবে কী? নিশ্চয় কায়দা কানুন আছে। এই ডামাডোল শেষ হোক, জিজ্ঞেস করব।
অবাক হচ্ছি ছবিকে দেখেও। সারা গা ঢেকে রাখে বোরখায়। পায়ে মোজা। হাতে মোজা। ভ্রু বাদে একটা লোম পর্যন্ত দেখিনি কোনোদিন। ওরও একটা সুতো পর্যন্ত নেই গায়ে।
সুতোবিহীন এই প্রাকৃতিক চেহারার আয়োজনটা কৃষ্টির জন্য।
কৃষ্টি আমার বন্ধু। শত্রুদের মধ্যেও ও-ই সবচে’ কাছের। ওর ছায়ায় আমাকে দেখা যায়; আমার ছায়ায় ওকে। আলাদা হলে একলা লাগে। তাই একসাথে উড়ি। একসাথেই পুড়ি। অথচ ও আত্মহত্যা করেছে, একা।
পরশু রাত। খেতে বসেছি। ফোন করল রাহিন। হন্তদন্ত গলা। কৃষ্টি আর নেই।
মজা করছে নিশ্চয়। প্রায়ই এমন করে ও। এমন সব ঘটনা সাজায়, পিলে চমকে যায়। তারপর এমন ভাবে হাসে, পিত্তি জ্বলে যায়। রাহিনকে দিয়ে ও-ই হয়তো মিথ্যেমিথ্যি সাজিয়েছে গল্পটা। শুরুতে তাই পাত্তা দিইনি। কিন্তু পরে শুনলাম, না, ঘটনাটা সত্যি। কৃষ্টি আসলেই নেই।
বাবা প্রেসারের রোগী। ঘুমের বড়ি খেতে হয় নিয়মিত। কৌটাভরা ঘুম নিয়ে জেগে থাকেন তিনি। তাতেই স্বস্তি খুঁজেছে ও। কিন্তু কেন?
কয়েকজনকে ফোন করলাম। জানে না। না জানলে মানুষ বেশি কথা বলে। ওরাও কী সব বলল গড়গড় করে। বুঝলাম না।
দ্রুত বের হলাম। চোখে জলের নহর। ভাসছে তাতে কৃষ্টির মুখ। সন্ধ্যাবেলার স্মৃতি।
তখন আমরা বসে ছিলাম মাঠে। বন্ধুবৃত্ত বড় হচ্ছিল। জমে গিয়েছিল আড্ডাটা। সবুজঘাসের জমাট জমিন তখন আকাশ। রংধনু এঁকে চলেছি আমরা। কথার। স্বপ্নের। গল্পের। গল্পগুলো ছুটছিল দ্রুত। পাগলা ঘোড়ার মতো। আজ থেকে কাল। কাল থেকে পরশু। অতীত থেকে আজ। আজ থেকে আগামী।
হঠাৎ উঠে গেল কৃষ্টি। কী যেন কাজ। দেখা করতে বলেছেন স্যার।
তাকিয়ে ছিলাম। চমৎকার করে হাঁটে ও। মাদল গীতল ভঙ্গি। এত ছন্দময়, দেখতেও সুখ সুখ লাগে। পোশাকে রুচির ছাপ। কথা বলে গুছিয়ে। শোনার সময় শোনে মন দিয়ে। ভীষণরকম অন্যরকম ও। আমরা কেউই ওর মতো না। ও না থাকলে তাই আড্ডার স্নিগ্ধ ভাবটাও থাকে না। স্বভাবতই কাঠখোট্টা আর নোংরা হয়ে উঠল আলোচনা।
ঘণ্টার কাঁটা খুব বেশি দাগ পেরোয়নি তারপর। এর মধ্যেই কী হয়ে গেল!
আবার রাহিনের ফোন। এবার একটু আশান্বিত কণ্ঠ। হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। লাইফ সাপোর্টে চলছে ঘড়িটা কৃষ্টির।
তার মানে আশা আছে! লাফিয়ে উঠলাম। কৃষ্টি আছে!
তার মানে আবার হয়তো আসবে ও। আবার হাসবে। হাসাবে। আবৃত্তি করবে। গাইবে। আবার।
পাশাবাশি বসা বন্ধুদের চুলে গিঁট দেবে তাদের অজান্তে। তারপর কেউ একজন উঠতে গিয়েই আটকে যাবে যখন, ক্লাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠবে কৃষ্টি। এমন সে আওয়াজ, শুনে কুম্ভকর্ণেরও ঘুম ভেঙে যাবে। আবার।
খুনসুটি করবে। মজা করবে। ভেঙচি কাটবে। এমনই অস্থিরতা ওর, তালে তালে অস্থির হয়ে উঠবে যেন দেয়ালও। আবার।
ছুটে যাবে মানুষের বিপদে। অনাচারের প্রতিবাদ করবে। নিরুপায় হলে মুষড়ে পড়বে। আবার।
কতকিছু হওয়ার কথা ওর। কৃষক ডাক্তার পুলিশ রাজনীতিবিদ শিক্ষক। এক একদিন এক এক পেশা ভালো লাগবে। গালভরে তার কারণও দর্শাবে। কোনো কোনো দিন বিরক্তি দেখাবে- এত অবিবেচক কেন আমরা? এত অমানবিক কেন? কা-জ্ঞান উৎপাদনকারী কারখানা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করবে। করবে সহনশীলতা আর দেশপ্রেম উৎপাদনের কারখানাও। দেশময় সেসব বিলি করা হবে বিনামূল্যে। ‘না, না, ফ্রি পেলে বাঙালি আলকাতরা নেয় ঠিক, কিন্তু খায় না। যখনই দেখে আলকাতরা তখন ফেলে দেয়। ফ্রিতে না, সুলভ মূল্যে বিলি করব। একটু হলেও তখন মানুষ হবে বাঙালি।’ বলবে এমন ঢঙে, মনে হবে সত্যিই কা-জ্ঞান উৎপাদন করা যাবে, বানানো যাবে দেশপ্রেম। আর সেই সালসা টনিক খেয়ে ইংরেজ আমেরিকান হবে বাঙালি। আমরা শুনব আর হাসব। ওকে দেখব আর স্বপ্ন দেখব ওর মতো হওয়ার।
নীলাকাশ পছন্দ না ওর। সবুজ একটা বানাবে। লাল সূর্য উঠবে যখন, মনে হবে প্রিয় পতাকাখানা ঝুলছে। দুলছে। বলবে আর দুলবে ও নিজেই। চোখ ভিজে যাবে। আবার। কিন্তু যদি না ফেরে? যদি আর না কাঁপে ভুরুজোড়া ওর? যদি আর না ঘোরে ঘড়ির কাঁটা? যদি আর না নড়ে হাতের আঙুল? ভাবতে ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল দম নিতেও।
আমরা ছুটছি শহরের পথে। হাবুডুবু খাচ্ছি কান্নায়। সাঁতার কাটছি আশানিরাশার স্রোতে।
একঘুম প্রায় দিয়ে উঠেছে রাত। আড়মোড় ভাঙছে। আরেক ঘুমে ডুববে। আমাদের ঢেউটা তখন আছড়ে পড়ল ইমার্জেন্সিতে। গিজগিজ করছে লোক। কাচঘেরা ঘরটার সামনে শিকড় গেঁড়েছে ওর পরিবার। ওদের সাথে মিশে গেলাম শোকদলিত মলিন করুণ ফুলগুলো সব। এক হয়ে বাধা পড়লাম এক আশার সুতোয়।
বহুখনপর ডাক্তার বেরোলেন। বললেন তারা চেষ্টা করছেন। বাকি সব স্রষ্টার হাতে।
ওঁদের হাতেই থাকল সব। আমরা লেগে গেলাম কাজে। একটাই প্রশ্ন সবার। এমন কেন করল ও? ও কেন এমন করল?
খুব ভালো ছাত্রী কৃষ্টি না। কিন্তু নম্বর পাওয়া না পাওয়া দিয়ে ওর মতো মানুষকে বিচার করা যায় না। ওকে বিচারের মান ও নিজেই। সবারচে’ ভালো ও। আর সবারচে’ সৃজনমুখী। সবচে’ আলোকিত। সংস্কৃতিপ্রাণ চৌকস এমনই এক মানুষ ও, যার আলোয় পথ দেখে সময়। সে-ই কেন আঁধার খুঁজবে?
সময়টাই এখন এমন। যখন তখন যা কিছু ঘটে যেতে পারে। পাশের ঘরেই হয়তো বাসা বেঁধে আছে বিপর্যয়, আমরা খেয়ালও করিনি। পাশের ঘরই বা কেন, নিজের ঘরেই যে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, ঘটার আগে ধারণাও কি করতে পারছি? তবে কৃষ্টির ব্যাপারটা অন্তত আন্দাজ করা যাচ্ছে।
আড্ডা ছেড়ে ও স্যারের কাছে যাচ্ছিল। সন্ধ্যা তখন উৎরে গেছে। ডিপার্টমেন্ট ফাঁকা। একটা দুর্যোগ সেখানে ঘটতেই পারে। শেষ স্ট্যাটাসটা দেখলাম। ‘আপনার মতো উচ্চ-অশিক্ষিত অমানুষেরা আজকের দিনের সেলেব্রিটি, বীরের বেশে আছে, তাই আমার থাকা হলো না’। ক্যাম্পাস থেকে ফিরেছে নয়টার দিকে। খালাম্মা অসুস্থ্য। নিজে খেতে পারেন না। প্রতিদিন ও-ই খাওয়ায় মাকে। বছর দুয়েক এ-ই নিয়ম। ওইদিন তাও নাকি করেনি। ঘুমোতে গেছে সোজা। তখনই হয়তো খেয়েছে বড়িগুলো। তার আগে এটাই শেষ যোগাযোগ। কিন্তু ‘আপনি’টা কে?
স্যারের দিকেই আঙুল সবার। সবারই এক মত। স্যারই কালপ্রিট।
মানুষ হিসেবে আমাদের স্যারেরা ভালোই। শিক্ষক হিসেবেও। উনিও খারাপ না। কিন্তু আলুর দোষ আছে। কেউ কেউ অবশ্য বলে, স্যারের দোষটা কলার।
চিন্তাচেতনায় মধ্যযুগীয়। চলনেও তাই। বলনেও।
ছাত্রীরা তার কাছে শিক্ষার্থী না, মানুষ না; স্রেফ মেয়েমানুষ।
সংসারের কাজ থেকে শুরু করে সংগঠন- কাজের শেষ নেই তার। আর কাজে অকাজে খাটিয়ে মারেন আমাদের। যখন যা বলেন, করতে হয়। না করলে ধরা। তার বিশেষ পছন্দের শিক্ষার্থীরা বেশি নম্বর পায়। অন্যরা কম। ফলে বেশি পাওয়ার লোভে কেউ, কেউ কম পাওয়ার ভয়ে, লেগেই থাকে তার সাথে। ভূক্তভোগী না হলে বিশ্বাস করা কঠিন যদিও। কিন্তু এক না ঘটলে, এগারো কি রটে?
রাজনৈতিক লিঙ্ক আছে। কিছুদিন আগে একটা নির্বাচনেও জিতেছেন। তাই গুরুত্ব পান। তাছাড়া তিনি জনপ্রিয়ও বেশ। হাসিখুসি থাকেন। হাসান। নাকি সুরে ঢলঢলে প্রেমের গান করেন। জোকস বলেন। ব্রেইনলেস সব জোকস। বিলো স্ট্যান্ডার্ড ছেলেমেয়েরা খিকখিকিয়ে হাসে। চেম্বারে যায়। গল্প করে। পার্টি হয়! নানা পদের তরলও শুনেছি কলকলায় পার্টিগুলোতে।
পড়ান ভালো; পটান আরও ভালো। দুই সন্তানের জনক। ছ্যাবলামী যায়নি তবু। ঢলে ঢলে পড়েন এখনো। গলে গলে পড়েন।
এক আপুকে নিয়ে কথা শোনা যায় প্রায়ই। অন্য বিভাগের এক ম্যাডামের সাথে জড়িয়েও গল্প শুনি।
ফলে দৃষ্টি যে তাঁর ভালো না, বুঝতাম। কৃষ্টিও বুঝত। কিন্তু গা করেনি। ও-ই আবার কোনো স্যারের রুমে একলা যেতে না করত সবাইকে। কিন্তু নিজে সে বীরনারী, খোলামনের মানুষ, মিশত খোলামনেই। সেটাই কি কাল হলো শেষতক?
লোকটাকে একটা শিক্ষা দিতে হবে তা হলে। মেয়ে দেখলেই ছোঁক ছোঁক করার মজা দেখাতে হবে।
হাসপাতালেই ছিলাম। চোখে জেগে থাকল রাত। একটু ঝিমোল। একটু ঘুমোল। তারপর ফিকে হলো। সামনে তখন রাজ্যের মেঘ। বুকের ভেতর ঝড়। মাথার ভেতর আগুন।
সে আগুন নেভার আগেই জ্বালিয়ে দেবো সব। তাই বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
চেম্বারে আটকে রাখলাম স্যারকে। প্রশাসন ছাড়িয়ে নিল।
অবরোধ বসালাম। শিক্ষকেরা উঠিয়ে দিলেন।
মানববন্ধন করলাম। স্মারকলিপি দিলাম। কাজ হলো না। পোড়ার দেশ, দ্রুত কিছু হবে না, আবার দেরি হলেই সব ভুলে যাবে সবাই। এমনিতেই স্যারের পক্ষে যারা, একটাই কথা তাদের, প্রমাণ কই?
প্রথমে দারোয়ান বলেছে স্যারের রুমেই ঢুকেছিল কৃষ্টি। সে দেখেনি নিজচোখে। কিন্তু তালা দিতে গিয়েছিল বলে জানে, ওই ফ্লোরে তখন আর কেউ ছিল না স্যার ছাড়া। পরে অবশ্য স্বর পাল্টেছে সে। জিব হয়ে দাঁতের সাথে লাগতে যাওয়ার জোর নিশ্চয়ই তার নেই! তবে আশার কথা, সরব হচ্ছে সংবাদমাধ্যম। সুতোয় টান পড়তে শুরু করেছে। কিন্তু ক্ষমতার চেরাগ আছে যে! কী হবে বলা মুশকিল।
বিপক্ষদলের কয়েকজন শিক্ষক গলা ফাটাচ্ছেন ফেসবুকে। বললাম আমাদের সাথে যোগ দিতে। না, সহকর্মীর বিরুদ্ধে মাঠে নামা উচিৎ হবে না! ভোটের কারসাজি, বুঝি সব। আমাদের কাজ তাই আমরাই করব।
কিন্তু কী করা যায়?
জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে দেশের ক্ষতি। সেটা চাই না। ব্যতিক্রম কিছু করব। এমন কিছু, যা তাঁকে মনে করিয়ে দেবে তিনিও মানুষ। এমনই কিছু, যা তাঁকে শেখাবে নারীকে শ্রদ্ধা করতে হয়; ভালোবাসতে হয়।
ভাবনার ¯্রােতে ভেসেই চলেছি উথাল পাতাল। কিনার মিলছে না। মিলছে না তো মিলছেই না। তারপর যখন হতাশ খুব, হাল ছেড়ে দেবো, দেবো পাল ছিঁড়ে, তখনই কাজ হলো। মাথায় এল এই সমাবেশের চিন্তা।
একক্লাশ মেয়ে। দাঁড়িয়ে থাকব কাপড় খুলে। তাকিয়ে থাকব তাঁর দিকে। অপলক। কোনো কথা বলব না। শুধু দাঁড়িয়ে থাকব। ক্লাশভর্তি ছাত্রী। বিবসনা। চোখে ঘৃণার সাগর। সাগরে উত্তাল ঢেউ। ঢেউয়ের ফেনায় আগুন। জ্বলমান।
হাজার হলেও মানুষ তো, লজ্জা হবে। আর প্রতিবাদটা শুধু তার বিরুদ্ধে তো নয়, বুকের ভেতর ধর্ষক পুষে রাখা সাধুসমষ্টিকেও দিতে চাই ধাক্কাটা। জানাজানি হলে নিশ্চয় অন্যরাও বুঝবে।
বললাম বন্ধুদের। ক্ষুব্ধ সবাই। প্রচণ্ড রেগে আছে। চাচ্ছে শাস্তি হোক স্যারের। কিন্তু আয়ডিয়াটা পছন্দ হলো না। নতুন কিছু করতে গেলে এমন হয়, জানি। তাই লেগে থাকলাম। হলে গিয়ে গিয়ে বুঝোলাম। বাসায় বাসায় গিয়ে বুঝোলাম। আস্তে আস্তে হাওয়া লাগল পালে।
ক্লাশরুমেই করতে হবে কাজটা। অন্য মেয়েরা এবং ছেলেরা থাকবে বাইরে। সারি বেঁধে বসে থাকবে সারাটাক্ষণ। কোনো উচ্চবাচ্য হবে না। হট্টগোল হবে না। ওরা আমাদের এ্যালিবাই। ভেতর ভেতর আসল কাজ করে ফেলব।
ঠিক করলাম মোবাইল ক্যামেরা রেকর্ডার বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস আনা যাবে না। কোনোকিছুর প্রমাণ থাকবে না। থাকবে কিংবদন্তী। থাকবে শুধুই গল্প!
ছোটরা কেউ কেউ যোগ দিয়েছে আমাদের সাথে। বড়রাও।
বহু আন্দোলন করেছি, আয়োজন করেছি অনেক কিছুরই। কিন্তু এমন পাগল পাগল এমন উত্তেজিত এমন ক্ষ্যাপাটে বোধ করিনি কখনো। হাওয়ায় ভেসে চলেছি যেন। যেন চলছিও না, কেউ চালিয়ে নিচ্ছে অদৃশ্যে থেকে।
এতসব করার ফাঁকে ফাঁকে খোঁজ নিয়েছি কৃষ্টির। একেকবার একেক খবর। এই শুনি ভালোর দিকে। পরেই আবার যেই কে সেই। তবে অবনতি হচ্ছে না। এটাই স্বস্তির।
অস্বস্তি যদিও ছিল একটা। সন্দেহের বশে এমন একটা কাজ করছি। ঠিক হচ্ছে তো? স্যার যদি নির্দোষ হন! মানুষ তো পরিস্থিতিরও শিকার হয়। দোনোমনা ছিলাম। কিন্তু সেটা কেটে গেছে পত্রিকা পড়ে। স্যার বলেছেন, একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। এটা তার আর কৃষ্টির ব্যাপার। একান্তই ব্যক্তিগত। এটাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলে চলবে না।
এরপর আর সংশয় থাকে না। ডগমগ করছিলাম। বেরও হয়েছি টগবগিয়ে। কিন্তু কীভাবে কীভাবে দেরি হয়ে গেল। তবু দেখি অনেকেই আসেনি। কৃষ্টিরও এই সমস্যা। সবই করে, কিন্তু দেরিতে। ঢিলের একশেষ! আমি আবার উল্টো। সময় মেপে চলি। কারও বিলম্ব দেখে রেগে যাই। আজকের কথা যদিও আলাদা। এতবড় একটা ঝুঁকি নিচ্ছে সবাই। সময় একটু লাগবেই। ফোন করলাম। আসছে বলল। চলেও এল একে একে।
ক’জনের সাথে কথা বলে বুঝলাম আসবে না। না আসুক, প্রতিবাদ প্রতিরোধ ভেতর থেকে আসতে হয়, এ জোর জবরদস্তির কাজ না। মনটা ভেঙে গেল। একক্লাস মেয়ে দাঁড়াব ভেবেছিলাম, এখন অর্ধেকও পূরণ হয় কি না সন্দেহ। অবশ্য তেজ বেশি তো, অল্প মরিচেও যা জ্বলার তা ঠিকই জ্বলবে। সমস্যা হলো রুবি গাধিটাও আসেনি এখনও। এদিকে সব ঠিকঠাক। সময়ও হয়ে যাচ্ছে। ওর হিসাব বাদ দিয়েই তাই কাজ শুরু করলাম।
যদিও খুব গোপনে এগিয়ে নিয়েছি আলোচনা। তবু, মানুষের মন, বলা তো যায় না কখন কোন দিক দিয়ে শয়তানের সঙ্গী হয়। যে রুমে বসার কথা ছিল, নিরাপত্তার জন্য সেটা বদলে ফেললাম প্রথমেই। নতুন রুমে ঢুকেই ঠিকমতো আটকে দিলাম জানলাগুলো। কোনাকাঞ্চি সব চেক করলাম- নাহ্, ক্যামেরা ট্যামেরা নেই। নিশ্চিত হয়েই তারপর প্রস্তুত হতে বললাম মেয়েদের। বললাম বটে, কিন্তু নিজেই ছাই বিশ্বাস করতে পারিনি নিজেকে, ওরা পারবে কীভাবে? একজনও নড়ল না। বাধ্য হয়ে আমিই শুরু করলাম। জিন্সটা নামাচ্ছি যখন, দেখি ওরাও হাত লাগাল। তারপর জাদু। দেখছি আর অবাক হচ্ছি। কী পরিমাণ রহস্য আমরা লুকিয়ে রাখি কাপড়ে! পৃথিবীর সামনে কী নিবিড় আড়াল হয় আমাদের পোশাক!
এতজনকে এভাবে দেখিনি কখনো। অবিশ্বাস্য লাগছে।
ফোন করল রুবি। কৃষ্টির জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু শঙ্কা পুরো কাটেনি। ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। ঘুমের মধ্যেও নাকি কেঁপে কেঁপে উঠছে আজ। নিশ্চয়ই ও আমার এই পরিকল্পনার কথা বুঝতে পেরেছে। বছরের প্রতিটা আয়োজনে আমরা ছায়ার মতো লেগে থাকি, কাঁধ মিলিয়ে টেনে নিই কাজের জোয়াল। আর আজ ও শুয়ে আছে আধমরা, দৌড়ে বেড়াচ্ছি আমি। চোখ ভরে এলো। সামলে নিয়ে তাড়া দিলাম রুবিকে। বলল, হাসপাতাল থেকেই রওনা করেছে ও। চলেও এসেছে প্রায়। আর মিনিট পাঁচেক লাগবে। স্যার কোথায় জানতে চাইলো। আসেননি শুনে ডাকতে বলল। এই রে, আবার তো কাপড় পরতে হবে।
জিন্স আর ফতুয়ায় গা গলিয়ে নিয়ে দ্রুত বের হলাম আমি।
উত্তেজনা আর ক্ষ্যাপাটে ভাবটা কেটে গেছে। ভয় ভয় করছে এখন। এত বড় একটা ঝুঁকি নিচ্ছি, পার পাব তো? এত বড় ধাক্কা দিতে যাচ্ছি, দেয়াল টলবে কি না সে তো পরের কথা, কিন্তু হাড় বাঁচবে তো আমার? কেমন যেন খালি খালি লাগছে ভেতরটা। কেমন যেন কাঁপা কাঁপা লাগছে বুক। তবু হাঁটছি, হাঁটাই যেন কাজ।
ওদিকে কোথাও গান বাজছে মাইকে। ‘এই শিকল পরা ছল, মোদের এই শিকল পরা ছল।’ যখনই এটা শুনি, শিউরে উঠি আমি। জোর জাগে, গায়ের রোম কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ভীষণ সাহস ভর করে বুকে। ফলে পরিস্থিতি অনুয়ায়ী গানটার প্রায় আবহসংগীতের কাজ করার কথা। তবে আজ তা হচ্ছে না। ভেতরের ভয়টা যেন কাটছেই না।
মুখোমুখি ক্লাসরুমগুলোর মাঝের করিডোর পার হলেই বেশ একটু ফাঁকা যায়গা। সিঁড়ির উঠোন, লোকে বলে ল্যান্ডিং। একটা জানালা আছে এখানে। ফাঁক পেয়ে আলো ঢোকে হুড়মুড়িয়ে। বাতাস ঢোকে। আকাশও।
ফাঁক পেলে এখানে আমরাও দাঁড়াই। খোলা আকাশে শ্বাস ফেলি। কখনো হ্রস। কখনো দীর্ঘ। কোনো শ্বাসে মিশে থাকে মাখনের মতো স্বস্তি। কোনোটাতে পিংপং বলের মতো আনন্দ। আবার কোনোটাতে ইটচাপা পড়া ঘাসের মতো হতাশা। আজ বেরুচ্ছে ঘৃণার আগুন।
নিজেকে একটু শান্ত করতে তাই দাঁড়ালাম ওখানে। জানলা বরাবার দূরে দাঁড়িয়ে আছে ঝাঁকড়ামাথা বুড়ো গাছটা। তার নিচে রঙের মেলা। আমাদের এ্যালিবাই। ষাট পঞ্চাশেক শিক্ষার্থী বসে আছে। সবাই মুখোশ পরা। দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না; তবে খুঁজে খুঁজে কিনেছি, তাই জানি মুখোশগুলো না নারীর, না পুরুষের। ওগুলোতে জেগে আছে মানুষের অবয়ব। চোখগুলো ফিতায় ঢাকা। কিছু দেখছে না ওরা। বলছেও না কিছু। টুঁ শব্দটি নেই। নিথর এক নীরবতা ছেয়ে আছে ওদের। এমনই চেয়েছিলাম। ঠিক আছে সব। আশ্বস্ত হয়ে পা বাড়ালাম আবার।
বিভাগীয় প্রধানের চেম্বার। তারপর রবস্যারের। পরেরটা খালি। তারপরেই কাক্সিক্ষত ঘর।
দাঁড়িয়ে আছি। সামনে দরজা। দরজায় নেমপ্লেট। ড. অমুক।
ঢুকে পড়ব? নাকি নক করব? ভাবছি। ভদ্র থাকার অবস্থা কি আছে? মানুষের সাথে মানুষের ব্যবহার, পশুর সাথে পশুর। কিন্তু পশু হতে পারলাম না। নকই করলাম শেষ পর্যন্ত।
ঠক ঠক। সাড়া নেই।
ঠক ঠক ঠক। সাড়া নেই।
কিছুক্ষণপর অনুমতি মিলল। এ ঘরেই সর্বনাশটা ঘটেছে। তাই রুচি হলো না ঢুকতে। ঠেলা দিলাম দরজাটা। দেখেই বকতে শুরু করলেন স্যার। বিরক্তিমাখা বিষাক্ত স্বর। কী শুরু করেছি এসব আমরা? ‘ওখানে সং সেজেছে ওরা কারা? কী লাভ এসব করে? তার চাইতে বরং দোয়া কালাম পড়ো, ইবাদত বন্দেগি করো। তাতে করে বেঁচেও যেতে পারে মেয়েটা। কী অবস্থা ওর এখন?’
উত্তর দিলাম না। ক্লাসের কথা বললাম। তারপর হাঁটা দিলাম।
হাত-পা কাঁপছে। অস্থির লাগছে। কুরুক্ষেত্রে রওনা করেছি যেন।
হাঁটছি। আর হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতেই এগিয়ে এল কিশোরকাল। চোখে লাগল পুরোনো ঘরের আবছা আলো। নাকে আসলো গোয়ালের চুনাকাদার ঘ্রাণ। ছ্যাঁতলাজমা মাটি আর আঁশ ছাড়ানো পচা পাটের মিলিত সোঁদা গন্ধ যেন দখলে নিল আমায়। গল্লা গল্লা পাটকাঠি শুকোচ্ছে উঠোনে। রাজহাঁস ডাকছে। প্যাঁক প্যাঁক শব্দে কান কাড়া দায়। পেছনের বাঁশঝাড়ে শনশন হাওয়া। বিষণ্ন সেই সন্ধ্যাই যেন ফিরে এল অবিকল। ফিরে এল হায়েনাটাও। ছিঁড়েখুঁড়ে খেলো আমায়। চেটেপুটে খেলো। তারপর চলে গেল। যাওয়ার পথে ফিরে তাকালো। শান্ত। স্বাভাবিক। যেন হয়নি কিছুই।
অথচ কত আপন তিনি আমার। কত নির্ভর করতাম তার ওপর। আমায় তিনি গান শোনাতেন। লাল নীল পরির গল্প শোনাতেন। কিনে খাওয়াতেন ক্রিমবল আর কাঠি লজেন্স আর লাঠিবিস্কুট আর আরও এটা সেটা। সেসব হাতে দিয়েই তিনি হাতড়ে নিতেন দেহ আমার। কিন্তু আমি তো ছোট, বুঝিনি কিছুই। বুঝিনি তিনি মানুষ নন। মুখোশ ছেড়ে যখন পুরুষ হলেন, তখন বুঝলাম। উহ্! কী যন্ত্রণা! এখনো কুঁকড়ে উঠি ভাবলে।
আর মা এসে কিনা বলল চুপ থাকতে! কাউকে কিছু বলা যাবে না। ঝামেলা বাড়বে। দুর্নাম হবে, ক্ষতি তাতে আমাদেরই।
ক্ষতি কিসে? মুখ খুললে, নাকি বুজলে? কীসের ভয়ে চুপ থাকি আমরা? কোন জুজুর ভয়ে মেনে নিই সবকিছু? অন্যায়ের শিকার একটা কুকুরও ঘেউঘেউ করে। কিছুই করতে পারবে না জেনেও দাঁতমুখ খিঁচিয়ে প্রতিবাদ করে বিড়ালও। বিচার চায়। আমরাই শুধু শাস্তি দিই নিজেদের। কৃষ্টি যেমন দিয়েছে। অথবা বয়ে যাই নীরবে সব। যেমন আমি যাচ্ছি। এখনো আমায় কুরে খায় এই চুপথাকা। জ্বালাটা এবার জুড়োবে একটু হলেও।
কিন্তু সে গুড়ে বালি। ক্লাসে ঢুকেই ধাক্কা খেলাম উল্টো। কাপড় চোপড় পরে ফুলবিবি হয়ে বসে আছে সবাই! রুবির কাজ। শুরু থেকেই আমার সাথে ছিল ও। কিন্তু মত বদলেছে এখন। মানুষকে লজ্জা দেয়া যায়। কিন্তু যে পশুরও অধম, তাকে কী করে দেবো? যা-ই আমরা করি না কেন, বুঝবে না সে। উল্টো তাজাতরুণ শরীর দেখে মজা লুটবে। আর আড়াল পেলেই হাত মারবে আমাদের কল্পনায় এনে। কেন শুধু তার লালসার খোরাক হব?
কথা ঠিক। এভাবে ভাবিনি আমি। তাই বলে থেমে যাব? মেনে নেব অন্যায়টা?
না। চুপচাপ বসতে বলল ও আমায়। মুখোশ পরালো সবাইকে। আমাকেও দিল একটা। পরলাম না। কী লাভ এতে? যে বোঝে না, তার কাছে মুখও যা, মুখোশও তো তা-ই! দাঁড়িয়ে আছি। হতাশ। মনোবলহীন। ক্ষুব্ধ। চোখ পড়ল পেছনের এক চেয়ারে। বসে আছে স্যারের মেয়েটা। কী যে কিউট এই পিচ্চি! খলখল করে হাসে। থলথল করে হাঁটে। আর কলকল করে কথা বলে। যে-ই দেখে, কোলে নিতে চায় সবাই। কৃষ্টিও নিত। আদর করত। আমিও। কিন্তু এখন বিরক্ত হলাম। কীসের মধ্যে কী।
ভাবতেই তড়িৎ খেলল মাথায়- স্যার কি জেনে গেছেন ব্যাপারটা? স্যারের কথাতেই কি রুবি প- করেছে সব? হতে পারে। না হলে পিচ্চিটাকে এনেছে কেন ও? এমন হলে তো কোনো কাজই করা যাবে না। এত কাছের বন্ধুও যদি বিরুদ্ধে চলে যায়, ষড়যন্ত্র করে ভন্ডুল করে দেয় আন্দোলন, তাহলে আর কাকে পাব কাছে? শালার এখানেও রাজাকার! হতাশ লাগছে খুব। আবার ব্যর্থ হলাম। না, এই সার্কাস দেখে সময় নষ্ট করব না। হাসপাতাল যাব। ফালতু ফালতু ক্লাসে বসে থাকার চেয়ে কৃষ্টিকে সময় দেওয়াই এখন জরুরি বেশি।
তবে বের হতেই বুঝলাম, এখনই যাওয়া হচ্ছে না আমার। জোকারের মতো লাফাতে লাফাতে এগিয়ে আসছেন স্যার। তার মধ্যেই ছোটবেলার সেই হায়েনাকেও দেখলাম যেন। সত্যি, অবিকল সেই লোক! আলাদা হয় মানুষের চেহারা, ধর্ষকের চেহারা এক। আমার ধারণা, পৃথিবীর সব ধর্ষক একই চোখে দেখে। গলায় তাদের একই ডাক। নখে একই ধার। ধর্ষক তাই ধর্ষকই। সে কারও আত্মীয় না। হুজুর না। শিক্ষক না। বন্ধু না।
ভাবতে ভাবতে ক্লাশে ঢুকলাম দ্রুত। এবং থ হয়ে গেলাম!
কিছুক্ষণপর স্যার ঢুকলেন। এবং থমকে দাঁড়ালেন।
ক্লাশভর্তি মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। মুখোশঢাকা মুখ। মুখোশগুলোতে কৃষ্টির ছবি। সব মেয়েই কৃষ্টি। প্রতিটা কৃষ্টিই হাসছে। ব্যঙ্গমাখা ধারাল তীক্ষ্ণ হাসি। সহ্য করা কঠিন। নড়তে পারারও কথা না স্যারের। তবু, তিনি তো তিনিই! দাঁত খিঁচে তাই ধমক দিয়ে উঠলেন একটা। আর তখনই এগিয়ে এল স্যারের মেয়েটা। কৃষ্টির ছবির মুখোশ একটা ওকেও পরানো হয়েছিল। খুলে ফেলেছে। গলায় ঝুলছে ওটা। বাবার দিকে এগিয়ে আসছে সে। টলমল পা, থলথল গা। ডাকছে স্যারকে। বাব্বা। বাব্বা। ঘুনশি ছাড়া গায়ে কিচ্ছু নেই পিচ্চিটার! আমার বুদ্ধিটা ঘুরিয়ে এমন জঘন্যভাবে কাজে লাগিয়েছে রুবি! এই ছিল ওর মনে?
সহ্য হলো না আমার। ছুটে গেলাম। কোলে নিলাম পিচ্চিটাকে। ওড়নাটা জড়িয়ে দিলাম গায়ে। কিন্তু ঠিক যেন সহ্য করতে পারল না সে আমাকে, চিৎকার জুড়লো। তাই নামিয়ে দিলাম। নেমেই আবার স্যারের দিকে যাচ্ছে সে। কাঁদছে। কখন যেন কেঁদে ফেলেছি আমিও।
কান্না লুকোতে লুকোতে ভাবছি, স্যার কি মাথাটা নিচু করে আছেন এখন? লজ্জায় তাকাচ্ছেন না কোনোদিকে? নাকি তাকিয়ে আছেন আমারই দিকে? ওড়না সরালে বড়সড় বুকটা আমার আরও বড় দেখায়। দেখে নিশ্চয় পুলক হচ্ছে তার। ঝিলিক দিচ্ছে চোখে। জিহ্বাটা কি ঝুলে গেছে? লালা পড়ছে?
জানি না।
তাকাইনি।
চোখ তখন বাচ্চাটার দিকে। কী মায়াময় ডাগর চোখদুটো বেয়ে অশ্রু ঝরছে তার! কী নরম গোটা গোটা পায়ে হাঁটছে! কী নিষ্পাপ স্বরে কাঁদছে!
আমার তো অসহায় লাগছে আবার। ভয় করছে। কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা? ও কি জানে ওর বাবা পুরুষ?

Leave a Reply

Your email address will not be published.