.
জাহিদুল ইসলাম সবুজ বলছেন, ‘‘কী দুদার্ন্ত একেকটা গল্প! পড়ে বারবার মনে হবে এভাবেও লেখা যায়! খেলার ছলে পড়ে গেলে গল্প বোঝা যাবে না বা অথবা কিংবার। পড়তে পড়তে গল্পে ঢুকে গেলে অদ্ভুত মুগ্ধতা ভেসে যেমন আসে তেমনি বিষাদে ছেয়ে যায় মন। নিমগ্ন বয়ানে লেখা সবগুলো গল্প প্রাণ ছুঁয়ে যায়।’’
*


৭.
শ্রদ্ধেয় কথাসাহিত্যিক হাসনাত আব্দুল হাই এর মূল্যায়ন

আশান উজ জামান নতুন প্রজন্মের লেখক যার গল্প সংকলন বা, অথবা কিংবা পড়ে মনে হল আমাদের কথা-সাহিত্যে একটা স্বতন্ত্র কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। গল্পে এবং উপন্যাসের বিষয় প্রায় সবই পুরনো, এখানে স্বতন্ত্র হতে হলে দুটো উপায় আছেঃ (এক) প্লট ও তার ওপর ভিত্তি করে যে ন্যারেটিভ বা বর্ননাভঙ্গি, তা পৃথক হতে হবে। অর্থাৎ গল্প বলার কৌশল নতুন হতে হবে। (দুই) ভাষা ব্যবহারে থাকতে হবে সতেজতা যা কাহিনীকে বিশেষ করে তোলে। গতানুগতিক পদ্ধতি অনুসরন করে লেখায় এই দুটি গুনের একটিও থাকে না। আশান উজ জামানের লেখা এর ব্যতিক্রম। এই জন্য নির্দ্বিধায় বলা যায় আশান উজ জামান এক নতুন কন্ঠস্বর যার লেখা আমাদের কথা-সাহিত্যে বাঁক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আশান উজ জামান এর গল্পের বিষয়ের সঙ্গে আমরা পরিচিত, যেমন ধর্ষণ, আত্মহত্যা, শিশু নির্যাতন, ধর্মান্ধতা, মানসিক কুসংস্কার -এই সব। তিনি পরিচিত বিষয়গুলি বলেন নতুন ভঙ্গিতে এবং নিজের তৈরি ভাষায়। নতুন করে বলার জন্য তিনি প্রায়ই ব্যবহার করেন পরাবাস্তবতা যেখানে জীবিত এবং মৃত চরিত্র পরষ্পর কথা বলে (কী আগুনে পুড়ে যায় ঘর, জানে না উঠোন) কিংবা শুয়ে থাকে পশাপাশি (ফুঁ), কাঠঠোকড়া পাখিকে দেখা যায় প্রতীক হিসাবে শহরের বহুতল বাড়ির জানালার কাচ ঠোকরাতে (কাচঠোকরা) এবং ধর্ষিতা নিজে যে দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল সেই দড়িতেই নিজের ঘরে ঝুলতে দেখে একজন ধর্ষককে (ফাঁস)। এই ভাবে গতানুগতিক প্লট আর বর্ননাভঙ্গি পরিহার করে তিনি যখন কাহিনী নির্মাণ করেন তখন পুরোনো বিষয়ও হয়ে ওঠে নতুন।
আশান উজ জামান ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করেন যা তার বর্ননাকে আপাতদৃষ্টিতে করে তোলে সরল। পড়ার পর বোঝা যায় এই সরলতায় প্রচ্ছন্ন রয়েছে ভাষার পরিকল্পিত এক নান্দনিকতা। তার বর্ননার অভিনবত্ব নির্মাণের এই আপাত সরলতা গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। অন্যদিকে, আঞ্চলিক ভাষার কুশলী ব্যবহার তার বর্ণনাভঙ্গিকে শুধু স্বাতন্ত্র্যই এনে দেয়নি, কাহিনীকে গতিশীলও করে তুলেছে। এই আঞ্চলিক ভাষা এতই মিষ্টি যে রুঢ়, কর্কশ বিষয়কেও মসৃন করে তোলে।
সব মিলিয়ে আশান উজ জামানের গল্প হয়ে উঠেছে উঁচু মানের সাহিত্য। তাকে অভিনন্দন।
*

৬.
সুহান রিজওয়ান এর পাঠপ্রতিক্রিয়া

“মুক্তিযুদ্ধকে আশ্রয় করে লেখা আশান উজ জামানের উপন্যাস অন্যচোখে পড়া হয়েছিলো বেশ আগে, মাঝে এলোমেলো নানা জায়গায় পড়া হয়েছে তার ছোটগল্পও। দেখার চোখজোড়া শক্তিশালী, গদ্যের ভাষাটিও তৈরি; লেখক সম্পর্কে এমন একটা ধারণা আগেই তাই মনে ছিলো। তবু চমকে উঠতে হলো আশানের গল্প সংকলন বা, অথবা কিংবা পড়ার পরে। চশমা পড়া বড়ভাইয়ের ভূমিকায় নেমে তাই বলেই ফেলি, যে ছোটগল্প পড়তে ভালোবাসেন যে সব পাঠক,  তাদের জন্য এই সংকলনটি সংগ্রহ করা রীতিমতো অত্যাবশ্যাক।

এক ডজন ছোটগল্পের এই সংগ্রহে দুর্দান্ত কাজ দেখিয়েছেন আশান। কখনো আঙ্গিকে (অ্যালবাম, তন্ত্র বা কাচঠোকরা-র মতো গল্পগুলো) কখনো বিষয় নির্বাচনে (আকাশ ভেঙে মুখে দিলেই বিদঘুটে স্বাদ), কখনো আবার ছোটগল্পের চিরন্তন সেই চমক লাগানো মুহুর্ত তুলে এনে (কী আগুনে পুড়ে যায় ঘর, জানে না উঠোন) আশান আশ্বস্ত করেছেন, বাংলা ছোটগল্প এখনো জীবিত। এক একটা আঞ্চলিক সংলাপে আশান এঁকে দিয়েছেন উত্তরবঙ্গের আস্ত এক একটা মানুষ; কখনো পাগলাটে কোনো কলেজ শিক্ষক, কখনো বাংলা সিনেমার চিরকালীন খলনায়ক কোনো চেয়ারম্যান।

আমাদের চতুর্দিকে চলমান জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা যে গল্পকারের চোখ এড়োয়নি, এবং সেটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে তিনি যে বরং নজর রেখে গেছেন সেইসব ঘটনার নানা মাত্রার অভিঘাতে; এই ব্যপারটিই সবচাইতে ভালো লাগার। সতর্কতা এই মাত্রায় উপস্থিত থাকার ফলে সামগ্রিকভাবে একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে গ্রামবাংলার একটা ছবি যেমন ফুটে ওঠে, ঠিক তেমনই রাষ্ট্র-সমাজ-কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিনিয়ত ঠাপ খেয়ে মৃয়মাণ হয়ে পড়া আমরা কোনদিকে যে আঙুল তুলবো,  তারও দিশা পাই না।

গল্পকারের সাক্ষর খানিক আলগা মনে হয় কেবল শিশু।স্বর্গ।নরক আর ফুঁ গল্পদুটির আঙ্গিক আর বয়ানেই। এক ডজনের বাকিগুলো পাঠককে এগিয়ে নিয়ে যায় জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার অনুসন্ধানে নয়, কেবল গল্পের সৌন্দর্য্যের জন্যই।

মনে রাখার মতো এই সংকলনের জন্য গল্পকার আশান উজ জামানের জন্য টুপিখোলা কুর্নিশ জানিয়েই এই সকালে শেষ করি।”

*

৫.
ইফতেখার হোসাইন রোমেলের পাঠপ্রতিক্রিয়া


পাঠক হিসেবে আমি নিম্ন মধ্যম মানের। তবে যত্ন নিয়ে ‘লেখা’ পড়ি। লেখকের মন বোঝার চেষ্টা করি। ‘বা, অথবা কিংবা’ পড়ার সময়টা সাধারণ সময়ের চেয়ে ভিন্নতর। সাধারণত বই পড়ার সময়- সময়, চরিত্র, পটভূমি, পারিপার্শ্বিকতা এ সমস্ত বোঝার সচেতন চেষ্টা থাকে। এবার এর সাথে যোগ হয়েছিল পাঠক হিসেবে সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি। ঘাবড়ে না গেলেও, খানিকটা সংকোচ, খানিকটা লজ্জা আর অনেকটা পরিতৃপ্তি অনুভব করেছি।
স্বভাবতই বইয়ের শুরুতে থাকা উৎসর্গের দিকে চোখ পড়েছিল শুরুতেই। যে সকল সংবেদনশীল, মায়াপ্রবণ মানুষকে উৎসর্গ করা হয়েছে, লেখক আশান উজ জামানকেও তাদের একজন বলেই মনে হয়েছিল। পরে বইয়ের পরতে পরতে সেই সংবেদনশীলতা আর মায়ার ছাপ দেখেছি। আঁখি নামের যে মেয়েটা মর্গে শুয়ে আছে, বা যে কাঠঠোকরা পাখিটা কাচের গায়ে ঠোকর মেরে চলেছে অবিরাম, অথবা শেফালি নামের যে মেয়েটা গলায় ফাঁস দিতে যাচ্ছে, কিংবা নুরির প্রিয় ‘হক স্যার’- সবাইকেই যেন ভীষণ মায়ায় যাদের চিত্রিত করা হয়েছে গল্পের ক্যানভাসে। খুব চেনা, খুব পরিচিত, নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বা দুর্ঘটনা যা-ই বলি না কেন, যেগুলো হয়তো খবরের কাগজের ‘অপরাধ চিত্র’ পাতায় কিংবা টিভি নিউজের বিশেষ প্রতিবেদনে অথবা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও বা স্থির চিত্রে চোখে পড়া সাময়িক আলোড়ন সৃষ্টিকারী। যা অচিরেই হারিয়ে যায় আমাদের দৃষ্টি, মন এবং মনোযোগ থেকে! লেখক সেসব ভুলে যাননি। তাঁর অন্তঃক্ষরণ টের পাওয়া যায়। তিনি গভীর মমতা বুকে নিয়ে আরো গভীরে যান সেইসব জমাট অন্ধকারে। ডুব দেন গহীনে।
আলাদা করে বললে, মনে খুব দাগ কেটেছে, ‘কাচঠোকরা’! অভিনবত্বের জন্য, গল্পের ভেতরে গল্পের জন্য, জটিল সুন্দর চিন্তার জন্য, আর “জানলাটার বয়স কত হবে?/কতগুলো নতুন বছর যে জানলাটা গ’লে ভেতরে ঢুকেছে, আর পুরনো হয়ে বেরিয়েছে, তার হিসাব নেই।” -এরকম কিছু লাইনের জন্য। ‘নবগঙ্গা’ খুব বাস্তব, রিলেটেবল। তবে কেন জানি মনে হলো, আকবার আলীর গল্পখানা শেষ প্যারার আগে এসে শেষ হয়ে গেলে পাঠক হিসেবে তৃপ্তি পেতাম বেশি। ক্লাইম্যাক্স হিসেবে সেটাই মনে ধরেছে। বাংলা গল্পে টুইস্ট এন্ড টার্নের দেখা পাওয়া বিরল। ‘ফুঁ’ গল্পটি সেই বিরল স্বাদ দিয়েছে আমাকে। আমি নুরুর চিন্তাধারা রিড করতে পারছিলাম, ক্ষেত্রবিশেষে প্রেডিক্টও করতে পারছিলাম পরে কী ঘটতে যাচ্ছে। কারণ এসব ব্যাপারে আগে আগে ভেবে রাখাটা- প্রচুর থ্রিলার, ডিটেকটিভ নভেল পড়া, মুভি দেখা আমার জন্য এক ধরণের আনন্দদায়ক মানসিক এক্সারসাইজ।
আশান উজ জামানের লেখায় মাটির গন্ধ আছে, আছে মাটির মানুষের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ, আর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ। ‘স্যাঁতসেঁতে অবসাদ’, আর ‘তুষজ্বলা অনুশোচনা’ – এরকম নান্দনিক উপমার দেখা পাই পড়তে গিয়ে। আরো পাই একটা গাছের কথা; যে গাছ ভেঙে পড়ে কোমর সমান উচ্চতায়। তখন ত্রিকোণমিতির সমস্যার মতো মাথাটা ছুঁয়ে থাকে ভূমি। পড়তে ভালো লাগে।
যা ভালো লাগেনি, তা হলো- পাঠক হিসেবে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগে ডাইভারসিটি খানিকটা কম বলে মনে হয়েছে। ঘুরেফিরে লেখকের নিজের অঞ্চলের ভাষাই এসেছে বারবার। এক দু’বার যে একঘেয়েমিতে পায়নি, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশের সব ডায়ালেক্টের প্রতিই আমার আলাদা দুর্বলতা কাজ করে; ভালোবাসাও। লেখকের কমফোর্ট জোনের বাইরে গিয়ে তাঁর মুন্সিয়ানা দেখতে চাই ভবিষ্যতে। একের পর এক গল্পগুলো যখন পড়ে গেছি, তখন ভাষার সাদৃশ্য আলাদা চরিত্র, আলাদা টেক্সট ও টেস্টগুলোকেও কোথায় যেন একসূত্রে গেঁথে ফেলছে বলে ভ্রম হচ্ছিলো! যদিও এটা আমার পাঠের সীমাবদ্ধতা হতে পারে, অথবা প্রগলভ প্রত্যাশা। এটা ধর্তব্যে নেয়ার মতো কিছু নয় বলেই আমি মনে করি।
*

৪.
রাইসুল সোহানের পাঠপ্রতিক্রিয়া

বা, অথবা কিংবা বইটা পড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যা বলে উঠলাম তা হলো, ‘বাব্বাহ! এইভাবেও টানা লিখে যেতে পারে কেউ!’

এবারের বইমেলায় ১৫ তারিখে হাসান ভাইয়ের সাথে দ্বিতীয় দেখা। একটু আধটু আড্ডা দিয়ে বললাম, ‘ভাই আপনার পছন্দের একটা বই কিনে দেন।’ পাশেই রিশাদ শুনতে পেয়ে বললো, ‘আশান ভাইয়ের বই কিন। মজা পাবি পড়ে।’ সেই সূত্রে এই বইটা আমার হাতে এলো। এবং বলাই বাহুল্য যে আলসেমির কারণে এতোদিন বইটা পড়া হয়ে ওঠেনি।

সব আলসেমি জয় করে আজকে পড়তে বসেই চমকে উঠলাম। প্রথম গল্পের প্রথম প্যারাটা পড়ে মনে হলো একি মুক্তগদ্য নাকি? বিভ্রম ভেঙে গেলো কিছুপরেই। এরপর তরতর করে এগিয়ে গেলাম, গল্পে ডুবে গেলাম। লেখার মধ্যে সে যে কী ঘ্রাণ! বাক্যগুলো ছোট ছোট কিন্তু ছুরিতে শান দেয়ার মতো ধার তাতে! কী করে লিখলেন এই লেখক! লেখায় এতো দক্ষতার মধ্যেও কোন খুঁত ধরা পড়লেও সেটাকে ঢেকে দিয়েছেন গল্পের চরিত্রদের প্রখর আঞ্চলিক কথোপকথন দিয়ে। এরকম পরিকল্পনা করে গুছিয়ে গল্প বলার ঢঙ অবাক করে দিয়েছে।

গল্পগুলোর বিষয়বস্তুতেও রয়েছে চমক। এইখানে লেখক আশান উজ জামান দেখিয়েছেন তার পর্যবেক্ষণ আসলে কতোটা তীব্র আর তীক্ষ্ণ! এজন্যেই তিনি গল্পের অংশ হিসেবে উপজীব্য করতে পেরেছেন সমসাময়িক নুসরাত হত্যাকাণ্ডকে “শিশু । স্বর্গ । নরক” গল্পে। ধর্ম ভেদাভেদ কতোটা নিষ্ঠুরভাবে ধরা দেয় তার চমক দেখিয়েছেন “কী আগুনে পুড়ে যায় ঘর, জানে না উঠোন” গল্পে। যেখানে এক হিন্দু নারী আর এক পুরুষের কথোপকথনে গল্প এগিয়ে যায়। কিন্তু পুরুষটি কি মুসলমান ছিলো? নিজেই গল্প পড়ে বের করে নিন!

সমসাময়িক ঘটনার মতোই আশান তুলে এনেছেন এদেশে সনদের তোয়াক্কা না করা মুক্তিযোদ্ধাদের টানাপোড়েন। রাষ্ট্র যে মুক্তিযোদ্ধাদের সত্যিকার স্বীকৃতি প্রদানে কতোটা অথর্ব তার প্রমাণ আমরা দেখতে পাই মুক্তিযোদ্ধার নতুন সনদ প্রদানে অফিসার হয়ে বসে আছে এক রাজাকার!

সর্বশেষ গল্প “আকাশ ভেঙে মুখে দিলেই বিদঘুটে স্বাদ”। সীমান্তবর্তী গ্রামে দুই দেশের সীমান্তের মাঝে ধরা পড়া রহমালিকে নিয়ে দারুণ এক প্লটের উপর নির্মিত হয়েছে গল্প। এর বেশি কিছু বললে গল্পের মজা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই পাঠককে আবিষ্কার করার সুযোগ রেখে দিচ্ছি।

গল্পগুলোতে মৃত্যু এতো বেশি করে এসেছে যে মনে পড়ে আমরা চোখ বুজে দিন পার করি। লেখক যেন আমাদেরকে ঝাঁকি দিয়ে বলতে চেয়েছেন, চোখ খুলুন, দেখুন প্রতিদিন কতো মানুষ লাশ হয়ে যাচ্ছে।

আমি আসলে ভেবেই পাই না এতো দারুণ ধারালো ঝাঁঝাঁলো লেখক থাকতে মানুষ কী করে ছাইপাশের বই কেনার জন্য স্টলগুলোতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুই পা এগিয়ে ভালো লেখা, এবং লেখককে তুলে ধরতে হবে আমাদেরই। ফালতু লেখক, এবং লেখা নিয়ে যতো হাইপই উঠুক, খুঁজে খুঁজে আমাদেরকে ভালো লেখার পঠনে ফিরে আসতেই হবে।

বর্তমান সময়ের গ্রাম বাংলার সমাজ, রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে কড়া নজর রেখে গাঁথা মোট বারোটি গল্প বাংলা সাহিত্যে দারুণ একটি সংযোজন। সময়ের সাথে এই গল্পগুলো কাল্ট ক্ল্যাসিক হয়ে উঠবে বলেই আমার ধারণা।”

১ মার্চ, ২০২০

*

৩.
মোঃ আসাদুজ্জামান এর পাঠপ্রতিক্রিয়া

“গল্পগ্রন্থ ‘বা,অথবা কিংবা’। ১২ টি ভিন্ন স্বাদের গল্প দিয়ে সাজানো বইটি।যাঁরা উদীয়মান লেখকদের লেখা পড়তে বসে ‘অপরিপক্বতার’ আশংকায় ভোগেন,তাঁদের জন্য সুখ বারতা হতে পারে আশান উজ জামান’র এ বইটি। প্রত্যেকটি গল্প শেষ পর্যন্ত আমাদেরই গল্প।খুব সময় নিয়ে,ধৈর্য ধরে লেখক গল্পগুলো লিখেছেন তা পড়লেই বোঝা যায়। প্রথম গল্পটিই আপনাকে চমকে দিতে পারে। পাশাপাশি শায়িত নর-নারীর আলাপচারিতায় দারুণভাবে উঠে আসে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় বাস্তবতা ও পুরুষের চিরকালীন নারীভোগী দৃষ্টিভঙ্গি। ‘দ্যাকলেন তো,যে-ই হোক আর যেকেনেই হোক,পুরুষমানুষ পুরুষই’- চরিত্রের মুখ দিয়ে বলা কথাটি তাই খুব প্রাসঙ্গিক মনে হবে আপনার। ২য় গল্প ‘শিশুস্বর্গনরক’ হয়ে উঠতে পারে শিশু অধিকার রক্ষার এক প্রতিবাদী দলিল। রাজন, রাকিব, আসিফারা এখানে রাজত্ব করেছে প্রতাপের সাথে। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক বিভ্রমতা, কোটা পদ্ধতি, মুক্তিযোদ্ধা সনদপ্রাপ্তির ভেতর-বাহির, স্বাধীনতাবিরোধীর স্বাধীনতার রক্ষাকর্তা বনে যাওয়ার ব্যাপারগুলো দারুণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে ‘নবগঙ্গা’ গল্পে। লেখকের চিন্তার জায়গা,দেখার চোখ আপনাকে একটু হলেও ভাবাবে।আর একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, কোনো গল্পের বিষয়বস্তুই আপনার কাছে আরোপিত মনে হবে না।হ্যাঁ,’পাল্টা হাওয়ার গান’ গল্পে ধর্ষণের প্রতিবাদ যেভাবে করা হয়েছে, তাতে আপনি ধাক্কা খেতে পারেন, তবে আপনার এটাও মনে হবে যে, এমন হলেই বরং ভালো হতো। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার স্থানীয়দের মুখে বলা ভাষা অত্যন্ত সাবলীলভাবে উঠে এসেছে গল্পকারের কলমে। তন্ত্র, ফুঁ, ফাঁস’সহ প্রত্যেকটি গল্পই যেন সমাজকে ভেঙে সাজানোর প্রয়াস, যেখানে আমাদের চারপাশ, ক্ষমতার কুৎসিত ব্যবহার,নরনারীর চিরকালীন পারস্পরিক আবেদন; কদর্য, সৌন্দর্য -দুটোই ধরা পড়ে। যা দেখি, যা শুনি, তারচেয়ে যে ঢের বেশি দেখি না, শুনি না এবং যা আপাতদৃষ্টিতে সত্য হয়ে সামনে আসে,তা সবসময় সত্য নয়, ‘ভ্রূণ’ গল্পটি পড়লে সে অনভূতি আরো পোক্ত হবে আপনার। ‘প্রতিটা তোলা ছবির পেছনেই লুকিয়ে থাকে না-তোলা ছবির এক একটা পুরো অ্যালবামা।’- ‘অ্যালবাম’ গল্পটির এই কথা অথবা ‘ইন্টারভিউ’ গল্পের শুরুতেই যখন লেখকের ভাষ্যে শুনবেন, ‘টিভির মধ্যে এক আলেক কথা বলছে, আর পাড়ার লোকেদের সঙ্গে বসে আর এক আলেক তা দেখছে- এই দৃশ্য কল্পনা করে কতবার যে গায়ে কাঁটা দিয়েছে আলেকের,তার হিসেব নেই।’, তখন আপনার ভেতর গল্পের পরিণতি সম্পর্কে স্বাভাবিক একটা কৌতূহল জাগবে কিন্তু অনুমান করতে পারবেন না নিশ্চিত। এই বইয়ের প্রতিটি ছোট গল্পের একটি করে বড় বিচরণ ক্ষেত্র রয়েছে। গল্প বলার ধরনটাই আলাদা।

তবে লেখক সম্ভবত আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগটা একটু বেশি করেছেন। আঞ্চলিক ও প্রমিতের ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয় হলে হয়তো আরো ভালো হতো। আর দু’একটি গল্পে পাঠককে বেশি চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করেছেন যা পাঠক হিসেবে সবসময় উপভোগের নাও হতে পারে।

লেখক পরিচিতি অংশে মাকে ‘সংসারশিল্পী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মধ্যেই শব্দ তৈরির ব্যাপারে লেখকের আগ্রহের ব্যাপারটি চোখে পড়ে। রচনাশৈলীও আরামদায়ক।গল্পের ভুবনে সকলকে স্বাগতম।
(বি.দ্র.এটা আমার প্রথম কোনো বই পর্যালোচনা। দুর্বলতাগুলো নরম দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।)”

*

২.
আহসানুল করিম এর পাঠপ্রতিক্রিয়া

“লাতিন আমেরিকার কোন এক অঞ্চলের ভূমিপুত্রদের কথা পড়েছিলাম, তাদের দেবতা ছিলেন একজন গল্পকথক। সেই জাতির পূর্বপুরুষদেরকে নিজের স্মৃতি থেকে তিনি শুনিয়েছিলেন মানুষের সৃষ্টির গল্প। বলেছিলেন মানুষের জন্ম হয় তাদের এই উৎপত্তির গল্প বলার সময়ে উচ্চারিত শব্দগুলো থেকে। যখনি তিনি সেই গল্প বলতেন, মানুষেরা জন্ম নিত। বারবার। মৃত ঈশ্বরের এই পৃথিবীতে এমন সৃষ্টিপুরাণ বড় চমৎকৃত করেছিল।

গল্পপাঠের অনুভূতি লিখতে গিয়ে এই কথা কেন?

গল্পগুলো পড়তে গিয়ে দেখা গেল আমাদের সামাজিক বাস্তবতার এই গল্পগুলো আমার কিংবা আমাদের কাছে একেবারে অচেনা নয়। সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় কলামে কলামে এমন অসংখ্য ঘটনার মিছিল।

বেঁচে থাকার তাগিদে এমনভাবে নিজেকে বিবর্তিত করে নিয়েছি যে সেইসব রিপোর্ট মনে ক্ষীণতম আঁচড়ও কাটতে পারেনি। লেখকের কাঁধে এসে ভর করা সেই পূর্বপুরুষের দেবতা সেসব কাহিনী নতুন করে বলে গেলেন নানারকম শিরোনামে। ছোট ছোট বাক্যগুলো নিজেদের মাঝে ফিসফিস করে গেল। না তোলা ছবির সেই এলবামে গল্পগুলো ভেসে বেড়াল অনেকগুলো রক্তাক্ত আলোকচিত্র হয়ে। ক্ষণিকের জন্য অনুভব করলাম ভিতরের মরচে ধরা সংবেদনশীলতার জেগে ওঠা। এখনো তবে মানুষই আছি – ভেবে কি আশ্বস্ত হলাম?

গল্পগুলো নিয়ে অভিযোগ নেই তা বলব না। অনেকগুলো গল্প নিয়েই নালিশ আছে। কিন্তু সেইসাথে আছে ভালোলাগা। কেননা একটি গল্পও ক্ষণিকের জন্যও আরাম দেয়নি।”

*

১.
আসাদ রানার পাঠপ্রতিক্রিয়া

“গল্পগ্রন্থ। শরীর জুড়ে বারোটা গল্প নিয়ে বেড়ে ওঠা বা, অথবা কিংবার।
উৎসর্গপত্র দেখেই চমকে উঠেছি। এমন করেও বই উৎসর্গ করা যায়! লেখকের প্রথম বই অন্যচোখের উৎসর্গটা দেখা থাকলে অবশ্য এটাকে তাঁর জন্য স্বাভাবিকই মনে হবে। যাহোক, বইটি লেখকের দ্বিতীয় গ্রন্থ হলেও সহজ সরল বর্ণনা, বুদ্ধিদীপ্ত আর চমৎকার উপমার প্রয়োগ দেখে মনে হয়েছে লেখালিখিতে হাত পাকিয়ে তবেই তিনি এসেছেন।
বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে বইয়ের ব্যাপারে আমি আমার ভালো-মন্দ লাগা বিষয়গুলো সংক্ষেপে বলব।

বইয়ের অ্যালবাম খুব অভিনব একটা গল্প! প্রথাগত লেখা না, এটা একের পর এক ছবির বর্ণনা। ছবিগুলো বর্ণনার জোয়ারে ভাসিয়ে আবার ভাটির টানে ফিরিয়ে এনেছেন গল্পের রূপে। রূপ থেকে যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে আলো কিংবা আগুন।

ঐ আগুনই বোধহয় জ্বলছিল রহমালির আকাশ সমান বুকে, পুড়িয়ে ফেলতে চাইছিল সব আইন, যা ভেঙে ফেলেছে তার আকাশ। কিংবা ছুটে যেতে চাইছিল এক নিশ্বাস দূরে থাকা করমালির কাছে।

‘যতবার পানি হই, আহ্বানে আহ্লাদে লুটিয়ে পড়ি, কচুর পাতার মতো ততবারই এড়িয়ে যায় আাঁখি’- বাক্যটা পড়েই বোঝা উচিত ছিল মাস্টারপিস একটা গল্প পড়তে যাচ্ছি।

মাস্টারপিস আছে আরও। কাচঠোকরা। এক কাচঠোকরা দেখিয়েও যে, মানুষের ভেতরের কথা বের করে আনা যায়, গল্পটা না পড়লে বিশ্বাস হতো না।

ফুঁ এর জোর যদি সাজুর উপর না প’ড়ে শিক্ষকরূপী জানোয়ারের উপর পড়ত তাহলে শান্তি পেতাম। শান্তি পেত কৃষ্টি বা তার বন্ধুরাও। হয়ত পাল্টা হাওয়ার গানটা আর লিখতে হতোনা লেখককে।

মনে হয়েছে, গল্পগুলো গল্প না, জীবন্ত। নাড়ালেই টুংটাং বেজে উঠে হাসিয়েছে বা, কাঁদিয়েছে অথবা ভাবিয়েছে, খুব।

মনে হয়েছে বা, অথবা কিংবা‘ যেন গল্পগ্রন্থ না, একটা ফুল- পাপড়িগুলো আলাদা রঙের ভিন্ন ঢঙের কিন্তু সুন্দর তার সাজ কিংবা সজ্জা বা, যেন ভাস্কর্য- যার শরীর জুড়ে বাক্যের কারুকার্য আর কপালজুড়ে ভাবনার ভাঁজ অথবা সাগর- যার বুক জুড়ে ঢেউ তুলেছে সময় আর রুঢ় বাস্তবতা কিংবা জীবনগাঁথা যেখানে বিচরণ করছে,

‘যে-ই হোক আর যেকেনেই হোক, পরুষমানুষ পুরুষই’ বলতে থাকা, স্বীকৃতি না পাওয়া আঁখি বা, ভ্রূণের সন্ধানে ঘুরতে থাকা হক স্যার অথবা নানা তন্ত্র- ধর্ম, আইন বা সমাজ, নিয়ন্ত্রণ করতে থাকা তান্ত্রিক- রাজনীতিক কিংবা ঘোর লাগা চোখে ফাঁস পানে চেয়ে থাকা শেফালীরা।

কাচঠোকরা, অ্যালবাম বা আকাশ ভেঙে মুখে দিলেই বিদঘুটে স্বাদ গল্পগুলোর চিন্তার পরিধি বা দৃষ্টির গভীরতা এতটাই বেশি, মনে হয়েছে গল্পগুলো দিয়ে লেখক চাইলেই কয়েকটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতেন।

ভালো লাগার কথা বলতে গেলে বলব, মুগ্ধ করেছে লেখকের স্বকীয়তা। মুগ্ধ করেছে গল্পের বয়ান এবং বয়নে লেখকের ভিন্ন মতে অন্য পথে হাঁটা। আর বাক্যে বাক্যে মুগ্ধতা এঁকে, গল্পে গল্পে ভাবনার খোরাক গেঁথে লেখাটাকে চমৎকার কিংবা দৃষ্টিনন্দন শিল্প তৈরির প্রচেষ্টা।

তবে খারাপ লেগেছে লেখকের নিষ্ঠুরতা। মনেহয়েছে অধিকাংশ গল্পই কোনো না কোনোভাবে দুঃখের কিংবা কষ্টের। তারপরই আসলো চিন্তাটা, গল্পগুলো যেহেতু আমাদের বা সমাজের অথবা সময়ের কথা বলছে সেক্ষেত্রে নিষ্ঠুর কে লেখক, নাকি সমাজ বা সময় নাকি আমরা??

গল্পের সূচিতে যে জীবনঘড়ি এঁকেছেন লেখক, ওই ঘড়িটা চলতে থাক, আজীবন।”

*

[লেখকগণের অনুমতিক্রমে এখানে সংরক্ষণ করা হলো]