১. হাসনাত আবদুল হাই, কথাসাহিত্যিক

সুস্বাদু খাবারের মত আশান উজ জামানের গল্প তারিয়ে তারিয়ে “খেতে” হয়; নাহলে যে সবটুকু স্বাদ পাওয়া যায় না তাইই শুধু না, অনেক সময় ভালোভাবে বোঝাও যায় না। “অনেক কথা যাও যে বলে কোনো কথা না বলি” কিংবা “শেষ হয়েও হইল না শেষ” — ছোটগল্পের এই মূলমন্ত্র তার লেখার পরতে পরতে। তার বলার ভঙ্গিটা প্রতারকের মত সরল( নিন্দার্থে নয়) কিন্তু পাঠক একটু অমনোযোগী হলেই গল্পের খেই হারিয়ে ফেলবে। অন্যভাবে বলতে গেলে, যে কাপড় তিনি বোনেন সেটি খদ্দরের মত মোটা আর সস্তা কিন্তু তার জমিনে থাকে নকশী কাঁথার সূক্ষ্ণ এম্ব্রয়ডারি। এই অলংকরন, যা তিনি ভাষার মাকু দিয়েই নিপুন হাতে টানা-পোড়েন করেন সে শুধু চমক সৃষ্টির জন্যই না, গল্পের আবহ তৈরির জন্য তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে পরিনতির ইঙ্গিত দেবার জন্যও। যেমন, “মাস্টারপিস” গল্পে আকাশে নানা রঙের খেলায় যে-ছবি, তা শুধু পটভুমি তৈরি করে না, গল্পের নায়কের নিয়তিও হয়ে দাঁড়ায়। “হুরময়” গল্পে মুতালেপ তার মৃত ছেলের ফিরে আসার কথা শুনে ধন্দে পড়ে তার স্ত্রী হুরের প্রতি তার দুর্বলতা প্রকাশ করবে কি করবে না, বুদ্ধিমতী হুর তা টের পেয়ে বিড়াল-ইঁদুর খেলার শেষে আচমকাই ধরা পড়ে যায় এবং ধরা দেয় তার অভিসন্ধির কাছে। এটা হয় শুধু দুজনের মৃত আব্দুলের পোষাক পরে ছদ্মবেশী হওয়ার জন্য নয়। গভীর রাতে ছেলের ঘরের দরজায় হুর ওরফে আলেয়ার মুখ দেখে মুতালেপ ভাবে “(ওয়াজ) মাহফিল থেকে বেরিয়ে ল্যাম্পের আলোয় যে দৃষ্টিটা সেদিন চোখে পড়েছিল মুতালেপের, এ দৃষ্টি সে দৃষ্টি না।” খুব সহজ ভাবে শেষ হয় না এই গল্প, হলে তা শুধু গল্পই হত, সাহিত্য না। “মোমজীবন” গল্পে বেশ একটা অস্বাভাবিক, প্রায় অবাস্তব, পরিস্থিতি তৈরি করেছেন লেখক স্বামী এবং স্ত্রী, আর দুজনের মাকেই সংসারে রেখে। আয়নার মত তারা একে অন্যকে দেখে সংসারের কাজ ভাগাভাগি করে নেন, কিন্তু সেব কাজের দায়িত্বে সমতা নেই, যার জন্য বালির ভেতর জলধারার মত একটা চোরাশ্রোত বয়ে যায় অলক্ষ্যে, কিন্তু দুজনেরই বোধের ভেতর থেকে। তাদের দুজনের মধ্যে যে টেনশন একজনের বউমা আর অন্যজনের মেয়ের প্রতি স্বামীস্ত্রীর ভিন্ন দৃষ্টির জন্য যা তাদের দুজনকেই অসুখী করে তোলে আর সেই সব মুহুর্তে তারা হয়ে যান একে অন্যের আয়না, সুখ-দুঃখের ভাগীদার। অন্ধকার ঘরে, বিজলি বাতি চলে গেলে, যে মোমবাতি জ্বলে সেখানে যেন ঠিকড়ে পড়ে অন্ধকার।এই গল্পে বাইরের ঘটনার জটিলতা না, মনের ভেতর ঢুকে অন্ধকারে অলোর সন্ধান করেছেন লেখক মনস্তাত্বিক হয়ে।সব গল্পেই আশান উজ জামান তার ট্রেডমার্ক আপাত সরল প্লটের ভেতর মোচড় (twist) দিয়ে বাক ফেরাতে পারেন নি। প্রথম গল্প “অভিনয়” প্রায় গতানুতিক ভাবে শেষ হয়েছে, পাঠকের জন্য কোনো ধাঁধা বা কৌতুহল সৃষ্টি না করে। এই গল্পের যা প্রধান আকর্ষণ তা হল ছোট ছোট বাক্য, ইংরেজিতে যাকে বলা যায় staccato, যা তার পরিচিত গদ্য থেকে পৃথক। এই ভাষা কাহিনীর সঙ্গে মানিয়ে গিয়েছে, কেননা, এখানে রহস্য রোমাঞ্চ আছে।লেখক হতাশ করেছেন সবচেয়ে মিষ্টি কিন্তু কঠোর জীবনের গল্প “হালকা প্রেমের ট্রেন” গল্পের পরিণতি দিয়ে। কাহিনীতে যে ট্রাজেডি ওত পেতে আছে তার আভাষ পাওয়া গিয়েছে আগেই। কিন্তু তাই বলে এমন নির্মম, বীভৎস পরিণতি? ট্রাজেডিটা অন্যভাবে, আরো একটু কোমল ভাবেও দেখানো যেত। আর দেয়ালে নায়িকার খুলি হরিনের মাথার মত টাঙ্গিয়ে রাখার মধ্যে কোনো প্রতীক নেই, বরং macabre এক দৃশ্য হয়ে থাকে।ছোট গল্প আকারে ছোট হওয়াই বাঞ্চনীয়। এই সংকলনে অনেক গল্পই বড় গল্প যার জন্য উপন্যাসের চরিত্র এসে গিয়েছে। লেখক ভাল করেই জানেন দুইটার কাঠামো আলাদা, শৃঙ্খলাও ভিন্ন। গল্প যত বড় হবে, ছোট গল্পের স্বাদ ততই কমে আসবে।গল্পগুলিতে ব্যবহৃত উপমা ও বাকপ্রতিমা বার বার পড়ার মত। এখানে আশান উজ জামানের জুড়ি নেই।
[কিছু বানান সম্পাদিত]