আশান উজ জামান

দেখা। লেখা। পড়া

‘আচ্ছা, পুতুলটার বয়স কত হবে?’ একজনের প্রশ্ন।
‘না হলেও তেরো-চৌদ্দ।’ পাশের জনের উত্তর।
‘উঁহু, পনেরো-ষোলোর কম না।’ আরেক জন বলল।
‘কী যে আন্দাজ-জ্ঞান তোদের! কোনোভাবেই ও বারোর বেশি না।’
‘হতে পারে। মুসলমান বলেই হয়তো অমন বাড়ন্ত শরীর।’
‘না, আমার মনে হচ্ছে হিন্দু।’
‘অন্য ধর্মেরও হতে পারে।’
‘নিশ্চয়ই ও ইউরোপিয়ান।’
‘চেহারায় তো আফ্রিকান আফ্রিকান লাগে।’
‘লাতিনও হতে পারে।’
‘চোখে কি কাঠের চশমা তোদের? ডাঁহা এশিয়ান ও।’
‘না না…’
এমনই তর্কের বাজার বসেছিল। কিন্তু এমন জায়গায় পুতুলটাকে এভাবে পাওয়া যে একটা সৌভাগ্য, সে ব্যাপারে কোনো দ্বিমত ছিল না। দ্বিমত হলো না সৌভাগ্যটাকে সাধ্যমতো উদযাপন করার ব্যাপারেও। একজন যদিও হালকা সংশয়ের ধুয়ো তুলেছিল। ‘যদি ধরা পড়ে যাই, যদি জানাজানি হয়!’ ‘তা ধরা পড়ব ক্যান পাগল? কাজ শেষে পুতুলটারে পুড়ায়ে ফ্যালব। নয় পুঁতে দোবো মাটিত। অত চিন্তে করিসনে, কাকপক্কিও জানবে না কিছু।’ সম্মিলিত সংকল্পে তাকে থামিয়ে দিয়েছে তারা।

উৎসব আয়োজনের দায়িত্ব পড়েছে সবচেয়েঅভিজ্ঞ সবচেয়ে ধুরন্ধর লোকটার ওপর। পড়তেই গর্বিত বাঘের পা ফেলে এগিয়ে গেল সে।
অস্বস্তি ভয় আর ঘৃণা নিয়ে পুতুলটা তখন সরে বসল একটু। কিন্তু কেউ যখন একা, যত সরেই সে যাক না কেন, একপাশ তার ফাঁকাই থাকে। সেপাশে বসেই লোকটা বিশ্রী কথার একটা গান ধরল। গানের তালে তালে ছুঁতে লাগল শরীর। তারপর হাত রাখল এখানে ওখানে সেখানে।

চিৎকার করতে করতে পুতুলটা দেখল, চরাচরে কেউ নেই তার ডাক শোনার। কেউ নেই, যাকে মানুষ বলা যায়। কিছু করতে হলে তাই নিজেকেই করতে হবে। ভাবতে ভাবতে কাঁদল পুতুলটা। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুছল।

ঢেউয়ের মতো ততক্ষণে এগিয়ে এসেছে নেকড়েরা। ছোঁ মেরেছে বাজপাখির মতো। খামছে ধরেছে হায়েনার নখ নিয়ে। ধরা পড়ে পুতুলটা মোচড় খাচ্ছে অবিরাম। হাত পা ছুড়ছে। আর বড় হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। বয়সের ছাপ পড়ছে শরীরে তার। লোকগুলোর চোখে চুর-নেশা, আর ঘন ঘোর। নইলে চোখের সামনেই বাচ্চাটার এমন করে বড় হয়ে যাওয়া দেখে তাদের আতঙ্কিত হওয়ার কথা। উলটো তারা আনন্দিত। ঘোরলাগা চোখে দেখল হাতেধরা পুতুলটা আর শিশু নেই। সে এখন টলটলে নদীর মতো। রুপালি রুপালি ঢেউ খেলছে সোনালি দেহে। ফলে ঘোরের সঙ্গে যোগ হলো খুশি। এক না চাইতেই হাজার পাওয়ার সে খুশিতে লাফাচ্ছে লোকগুলো।

কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই পুতুলটা হয়ে দাঁড়াল বেঁটে আর সাদা লোকটার মায়ের মতো। কালো আর লম্বা লোকটার কাছে দেবী মনে হলো তাকে। শ্যামলা আর মাঝারি লোকটা দেখল তাদের হাতে ধরাশায়ী তাদেরই বাচ্চামেয়ে। মেয়েটার মাথায় সিংহের কেশরের মতো ঢেউ খেলানো চুল। শিকারি বাঘের মতো শান্ত স্থির থমথমে ভাব মুখে। ঘৃণা আর ব্যাঙ্গ মেশানো একটা হাসি ভাসছে ঠোঁটে।

দেখেই কেঁপে উঠল সর্বশক্তিমান পুরুষগুলো। ছুট লাগাল যে যেদিকে পারে। টুকরো টুকরো হয়ে পুতুলটা তখন লেগে থাকল তাদের হাতে। কারও হাতে তার পা। কারও হাতে হাত। কারও হাতে বুক।

তারপর থেকে টেনে, ছিঁড়ে, কেটে—বহুভাবে চেষ্টা করেও লোকগুলো এসব ছাড়াতে পারে না হাত থেকে। না পেরে হাত কেটে ফেলে কেউ কেউ। তবু সেখানে হাত গজায়, করে ফেলা দুষ্কর্মের চিহ্নসহ। কাপড়ে ঢেকে রাখলে কাপড় পুড়ে যায়। নিজেরা লুকোতে গিয়ে দেখে সরে যাচ্ছে দেয়াল, কোথাও কোনো আড়াল নেই। কষ্টে আর লজ্জায় তারা কাঁদে। কিন্তু কান্না শুনে নিজেরাই আবার ভয় পায়। তারা না, কাঁদছে যেন জন্তু একপাল।

3 thoughts on “বৈশ্বিক

  1. সত্যিই এমন হলে খুব ভালো হতো।
    দারুণ কল্পনা!

Leave a Reply to আসাদুজ্জামান রানা Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *